যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাজশাহীতে এলেন পূর্বপুরুষের ভিটার সন্ধানে

শিকড়ের খোঁজে রাজশাহীতে এসেছিলেন অনিরুদ্ধ সান্যাল। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের ছবির পাশেছবি: প্রথম আলো

‘আমি ঠিক ঠিক আমার বাবার জন্মভিটায় এসেছি। আমার ভুল হয়নি। কারণ, সেই পুরোনো বাড়িটি যিনি কিনেছিলেন, সেই রজত আলী বাড়ির সামনেই ছিলেন। আমার বাবার স্মৃতিধন্য সেই বাড়িটি না থাকলেও বাড়ির মালিক ছিলেন। তিনিই নিশ্চিত করেছেন, এটি সেই জন্মভিটা। আমার বাবা ১২ বছর বয়সে শেষবারের মতো এই বাড়ি ছেড়ে যান।’ ৪ মার্চ বাবার জন্মভিটার খোঁজ পাওয়ার পর কথাগুলো বলছিলেন ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র বংশধর অনিরুদ্ধ সান্যাল।

অনিরুদ্ধ হলেন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাসচর্চার পথিকৃৎ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র (১৮৬১-১৯৩০) বংশধর। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র ছোট ভাই অশ্বিনীকুমার মৈত্রেয়র মেয়ে ছায়া মৈত্রেয়র নাতি হলেন এই অনিরুদ্ধ সান্যাল (৬০)। তিনি পেশায় ব্যাংকার; যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ব্যাংকে কর্মরত। নেশা তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণ।

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের বাড়ির জায়গায় এখন এই ভবন উঠেছে। সেখানেও অনিরুদ্ধ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহী নগরের খানসামার চক মহল্লায় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র ছেলে সুকুমার মৈত্রেয়র বাড়ি ছিল। সেখানে এখন নতুন ভবন উঠেছে। তার নিচতলায় এখন বইয়ের দোকান বাতিঘর। গত মঙ্গলবার বিকেলে সেখানে বসেই রাজশাহী নিয়ে কথার ঝাঁপি খুলে বসেছিলেন অনিরুদ্ধ সান্যাল। তিনি রাজা রামমোহন রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেকের জীবনের ওপর তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষের সন্ধানে নেমে পড়েন। পূর্বপুরুষদের খোঁজার জন্য সূত্র অনুসন্ধান করে বেড়াচ্ছিলেন। এরই মধ্যে দার্জিলিংয়ের শ্রীকান্ত রায় নামের এক ব্যক্তি তাঁকে রাজশাহীর অক্ষয়কুমার গবেষক শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন।
শফিকুল ইসলাম ১০ বছর ধরে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র ওপর গবেষণা করছেন। তাঁর এ বিষয়ে অন্তত ৫০টি নিবন্ধ বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ৪ মার্চ রাজশাহীতে এসে অনিরুদ্ধ তাঁর আতিথেয়তা গ্রহণ করেন।

ওই দিন বিকেলে রাজশাহীতে হজরত শাহ মখদুম বিমানবন্দরে নামেন অনিরুদ্ধ। সেখান থেকেই সোজা চলে আসেন পৈতৃক ভিটায়। জায়গাটি রাজশাহী নগরের পাঠানপাড়া এলাকায়। যখন তিনি পাঠানপাড়ায় পৌঁছান, তখন রাজশাহীতে বৃষ্টি হচ্ছিল। তাঁর বাবার ভিটায় এখন নতুন ভবন উঠেছে। তিনি ওই বাড়ির দিকে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকলেন বৃষ্টির মধ্যেই। তখন সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন মোহাম্মদ রিপন নামের এক ব্যক্তি। তাঁর দখলে বাড়ির যে অংশটি রয়েছে, সেখানে অনিরুদ্ধর বাবা কল্যাণ কুমার সান্যাল ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। স্থানীয় লোকজনের কাছে দীর্ঘক্ষণ তিনি পূর্বপুরুষের কথা শুনলেন।
পরের দিন ৫ মার্চ, মঙ্গলবার বিকেলে অনিরুদ্ধ এলেন বাতিঘরে। সেখানে রাজশাহীর সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে তাঁর বাবার স্মৃতিবিজড়িত রাজশাহীর বর্ণনা করলেন। কথায় কথায় তিনি বললেন, দেশভাগের সময় যাঁরা রাজশাহী ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁরা অনেকেই বলতেন ওপার বাংলায় জমিদারি ছেড়ে এসেছেন। তিনিও ভেবেছিলেন, তাঁর পূর্বপুরুষেরাও হয়তো সে রকমই বেশি বেশি গল্প করতেন। কিন্তু রাজশাহীতে এসে তিনি তার চেয়ে বেশি পেয়েছেন। যেটা তিনি কল্পনাও করেননি। তাঁর বাবার মামা দেব কুমার মৈত্রেয় রাজশাহীতে নিযুক্ত ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন। তাঁর পরিচয় খুঁজে বের করতে রাজশাহীতে সহকারী হাইকমিশনারের কার্যালয়ের অনার বোর্ড দেখেন অনিরুদ্ধ। সেখান থেকে দেব কুমার মৈত্রেয়র নাম পাওয়া গেল। অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র ভিটায় যে বাড়ি উঠেছে, সেখানেও তিনি হাত জোড় করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত বরেন্দ্র জাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। সেখানে তিনি ছুটে যান। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র ছবির কাছে অনেকক্ষণ হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকেন।

মামা দেব কুমার মৈত্রেয় রাজশাহীতে নিযুক্ত ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন। তাঁর পরিচয় খুঁজে বের করতে রাজশাহীতে সহকারী হাইকমিশনারের কার্যালয়ের অনার বোর্ড দেখেন অনিরুদ্ধ
ছবি: প্রথম আলো

মঙ্গলবার বিকেলে রাজশাহী থিয়েটার আয়োজিত পাঁচ দিনব্যাপী ‘৮ম অক্ষয়কুমার নাট্যোৎসব-২০২৪’-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে অনিরুদ্ধ সান্যাল বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগ দেন রাজশাহী জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোলাম সাব্বি সাত্তার। বিশেষ অতিথি ছিলেন ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার মনোজ কুমার ও বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব মলয় ভৌমিক। সেখানেও অনিরুদ্ধ একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। বললেন, যা শুনে রাজশাহীতে এসেছিলেন। তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছেন। রাজশাহীর মানুষ যে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়কে এভাবে মনে রেখেছেন; তাঁর নামে নাট্যোৎসব করেন, এটা দেখে তিনি অভিভূত হয়েছেন।
গত বুধবার বিকেলে অনিরুদ্ধ সান্যাল রাজশাহী থেকে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেন। যাওয়ার সময় অক্ষয়কুমারের লেখা বইগুলো বাতিঘর থেকে কিনে নিয়ে যান।