রোদ-গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা খুলনায়, বৃষ্টির অপেক্ষা

প্রচণ্ড রোদের মধ্যে একটি ভবনের পাশে ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন সবজি বিক্রেতা আখতারুজ্জামান। মাথায় দিয়েছেন সবজির ব্যাগ। বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরের নাজিরঘাট এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

খুলনার ডাকবাংলো এলাকায় নানা পদের শরবত বিক্রি করছিলেন সরোয়ার বিশ্বাস। দোকানের ওপরে থাকা ছাতায় রোদ মানছিল না। পাশের দোকানের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, গরমে বেচাবিক্রি বেড়েছে। আগে প্রতিদিন দেড় হাজার টাকা বিক্রি হলেও এখন দুই থেকে তিন হাজার টাকা হচ্ছে। তবে মার্কেট এলাকায় তেমন ক্রেতা নেই। দোকানের কর্মীরাই মূলত শরবত খাচ্ছেন।

প্রচণ্ড গরম ও কাঠফাটা রোদে খুলনার জনজীবন বিপর্যস্ত। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সরোয়ারের মতো খেটে খাওয়া মানুষের। তীব্র দাবদাহের মধ্যেও যাঁদের বের না হলে সংসার চলে না। আবহাওয়া কার্যালয় বলছে, খুলনায় কয়েক দিন ধরে চলা মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ আরও কয়েক দিন অব্যাহত থাকবে। তবে চলতি মাসের শেষে খুলনায় বৃষ্টির দেখা মিলতে পারে।

তীব্র তাপপ্রবাহে গরমজনিত রোগ বেড়ে যেতে পারে, সেই আশঙ্কায় খুলনায় গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে জেলা প্রশাসন। গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, খুলনার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বহমান। এ সময়ে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া রোদের মধ্যে বাইরে বের না হওয়া ও অসুস্থবোধ করলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াসহ বেশ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরের কয়েকটি সড়কে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ট্রাকে করে পানি ছিটাতে দেখা গেছে। সিটি করপোরেশনের গাড়িচালক মো. রাকিব জানান, গরম বাড়ার পর থেকে তাঁরা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিভিন্ন রাস্তায় পানি ছিটাচ্ছেন।

নগরের ডাকবাংলো এলাকায় ডাকবাংলো সুপার মার্কেট, রেলওয়ে মার্কেট, এম রহমান চেম্বার, খুলনা বিপণিবিতান, দরবেশ চেম্বার, শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিপণিবিতান, কাজী নজরুল ইসলাম মার্কেট, মশিউর রহমান মার্কেট, এস এম এ রব শপিং কমপ্লেক্স ইত্যাদি পৃথক নাম থাকলেও এলাকাটি ‘নিক্সন মার্কেট’ হিসেবেই নগরবাসী। সেখানে সব সময় ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকে। কিন্তু আজ বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বিপণিবিতানগুলোতে গিয়ে ক্রেতাশূন্য দেখা যায়। বিক্রেতারা অলস সময় পার করছেন। অনেক দোকানের তালা খোলেনি।

আরও পড়ুন

ডাকবাংলো সুপার মার্কেটের নিঝুম ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী এস এম আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিনের বেলা কোনো কাস্টমার আসছে না। সন্ধ্যার পর একটু বেচাকেনা হচ্ছে। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ বাইরে বের হচ্ছে না। এ জন্য অনেকে দেরিতে দোকান খুলছেন; কেউ কেউ বিকেলে আসেন। মার্কেটের বেশির ভাগ দোকানে বিকেলের আগে বিসমিল্লাহ হচ্ছে না।’

খুলনা বিপণিকেন্দ্রের মাহামুদ ফেব্রিকসের বিক্রয়কর্মী মোহম্মদ শের আলী বলেন, ‘কেনাবেচা নেই। সকাল থেকে দোকান খুলে বসে আছি। আসলে মানুষের বাইরে বের হওয়ার উপায়ই তো নেই। কাজ না থাকলে আমিও তো বের হতাম না।’

আরও পড়ুন

শিববাড়ি এলাকায় একটি বহুতল ভবনের নিচে দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিচ্ছিলেন রিকশাচালক মো. আলমগীর। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের বাসিন্দা আলমগীর খুলনায় ১৭ বছর ধরে রিকশা চালান। গরমের কারণে তাঁর আয় কমার পাশাপাশি ব্যয়ও বেড়েছে। আলমগীর বলছিলেন, ‘মালিককে ১০০ টাকা রিকশা ভাড়া দিতে হয়। আগে দিনে সব বাদ দিয়ে ৬০০-৭০০ টাকা নিয়ে ফিরতাম। এখন ৫০০-ও হচ্ছে না। গরমে মানুষ বের হচ্ছে না।’ পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে গুনে বললেন, ‘সকাল আটটায় বের হয়েছি। এখন ১২টা বাজতে গেল। মাত্র ১৪০ টাকার ভাড়া টেনেছি। প্রচণ্ড গরমে একটা খ্যাপ দেওয়ার পর জিরাতে হয়।’

দাবদাহে খুলনা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সড়কে সড়কে ট্রাক দিয়ে পানি ছিটানো হচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে লোয়ার যশোর রোডে
ছবি: প্রথম আলো

খুলনার সবচেয়ে বড় সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালে গিয়েও যাত্রী কম দেখা গেল। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বের হচ্ছেন না। খুলনা-মোংলা রুটের বাসচালক মো. শরীফ বলেন, ‘গরমে যাত্রী কম হচ্ছে। যারা আসছে, তারাও গরমে ঘেমে কষ্ট পাচ্ছে।’ নিরালা এলাকায় ইজিবাইকচালক হেদায়েত উল্যাহ বলেন, ‘দুপুর থেকে রাস্তা ব্যাপক গরম থাকে। পিচের গরমে হাত-মুখ পুড়ে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত রাস্তায় তেমন যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। তবে লোডশেডিং কম হওয়ায় রাতে আরামে ঘুমানো যাচ্ছে।’

চিকিৎসক দেখিয়ে বাড়িতে ফিরেছিলেন পাইকগাছার আকলিমা বেগম। কোলে শিশু নাতনিকে নিয়ে একটানা হাতপাখার বাতাস করছিলেন। আকলিমা বলেন, গরমে নাতনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় চিকিৎসক দেখাতে খুলনায় এসেছিলেন। এখন গরমে কীভাবে বাড়ি ফিরবেন সেই চিন্তায় আছেন।

আরও পড়ুন

খুলনা আবহাওয়া কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ঈদের পরদিন ১২ এপ্রিল থেকে খুলনায় তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। ১৬ এপ্রিল তাপমাত্রা ছিল ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর ১৯ এপ্রিল তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৭ ওঠে। ২০ এপ্রিল খুলনায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২১ এপ্রিল তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির নিচে নামলেও পরের তিন দিন ৪০ ডিগ্রির ওপরে ছিল। আজ দুপুর ১২টায় খুলনায় ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।

খুলনা আবহাওয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ বলেন, এপ্রিল-মে মাসে সাধারণত এমন তাপপ্রবাহ থাকে। খুলনায় এবারের তাপপ্রবাহ আরও দুই-তিন দিন থাকবে। ২৮-২৯ এপ্রিল খুলনায় বৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন