অবৈধভাবে ইতালি যেতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় মাদারীপুরের দুই ব্যক্তি মারা গেছেন বলে জানিয়েছে পরিবার। স্বজনেরা জানান, তাঁরা ২১ দিন আগে মারা গেলেও গতকাল মঙ্গলবার রাতে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
মৃত ব্যক্তিরা হলেন মাদারীপুর সদর উপজেলার ধুরাইল ইউনিয়নের চর বাজিতপুর এলাকার জাফর ব্যাপারী (৪০) ও সিরাজুল হাওলাদার (৩৫)। অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে তাঁরা ১ সেপ্টেম্বর বাড়ি ছাড়েন।
পুলিশ, এলাকাবাসী ও মৃত দুই ব্যক্তির স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় এক দালালের মাধ্যমে ঢাকা থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান জাফর ব্যাপারী ও সিরাজুল হাওলাদার। লিবিয়ার উপকূল থেকে ইতালি যেতে গত ১৪ অক্টোবর ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকায় ওঠেন জাফর-সিরাজুলসহ অর্ধশত ব্যক্তি। ভূমধ্যসাগরের মাঝামাঝি এলাকায় যাওয়ার পর নৌকার তেল শেষ হয়ে যায়। পরে সাগরে ভাসতে থাকে নৌকাটি। এক সপ্তাহ পর ২১ অক্টোবর তীব্র শীতে ঠান্ডায় জমে সাগরেই জাফর, সিরাজুলসহ কয়েকজনের মৃত্যু হয়। বিষয়টি দালাল চক্র গোপন রাখলেও গতকাল দুজনের মৃত্যুর খবর পান স্বজনেরা।
স্বজনদের অভিযোগ, মাদারীপুর সদরের চর বাজিতপুর গ্রামের বাসিন্দা ও মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য লোকমান সরদার নানা প্রলোভন দেখিয়ে ওই দুজনের পরিবারের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। টাকা নেওয়ার আগে তাঁদের জাহাজে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের ছোট্ট একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ওঠানো হয়। দুজনের মৃত্যুর পর গা–ঢাকা দেন লোকমান।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে লোকমান সরদার মুঠোফোনে দাবি করেন, তিনি মানব পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত নন। ওই দুই যুবকের মৃত্যুর বিষয়েও তিনি কিছুই জানেন না।
লোকমানের ভাবি ঝর্ণা আক্তার বলেন, ‘আমার ভাশুর কোনো দালাল নন। তাঁর দুই ছেলে ইতালি যাওয়ার পর এলাকার অনেকেই তাঁর কাছে আসেন। এতে তাঁর কোনো দোষ নেই। অন্য এক বড় দালাল আছে, তিনিই সব জানেন। তাঁর পরিচয় আমরা জানি না। তবে লোকমান ভাই জানেন।’
মৃত জাফর ব্যাপারীর ছোট ভাই জাকির ব্যাপারী বলেন, ‘আমার ভাই জাফর ও সিরাজ একসঙ্গে ছিল। আমরা জানতাম, দুজনই ভালো আছে। তবে লিবিয়ার পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে তারা নিখোঁজ আছে বলে জানায় দালাল। আমরাও দালালের কথা বিশ্বাস করি। মঙ্গলবার রাতে জানতে পারি, আমার ভাই আরও ২১ দিন আগে মারা গেছে। সিরাজও মারা গেছে। ঠান্ডায় জমে তারা নৌকার মধ্যেই মারা গেছে। ওদের সঙ্গে যারা ছিল, তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারপর দালালকে ধরলে দালালও মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছে। এখন আমরা কার কাছে যাব, কী হবে আমাদের?’
জাফরের বাবা লাল মিয়া ব্যাপারী বলেন, ‘দালাল লোকমান একসঙ্গে আমাদের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তখন বলেছিল, কোনো ঝামেলা ছাড়াই জাফরকে ইতালি পৌঁছে দেবে। কিন্তু সাগরেই আমার ছেলের মৃত্যু হলো। আর দালাল লোকমান বলেছিল, ওরা জীবিত আছে। কোনো চিন্তা করতে না বলেছে। এখন বলে ওরা আর বেঁচে নেই। যার কারণে আমার ছেলে মারা গেল, ওই দালালের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’
মৃত জাফর ব্যাপারীর দুই মেয়ে। একজনের বয়স ১৮ আর অন্যজনের ১৩। জাফরের স্ত্রী রুনা বেগম বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে নিয়ে কার কাছে যাব? কীভাবে ওদের দেখাশোনা করব? সবকিছু শ্যাষ হয়ে গেল আমার।’
মৃত সিরাজুল হাওলাদারের স্ত্রী নিলুফা বেগম বলেন, ‘আমার আড়াই বছরের ছোট একটা ছেলে। ও এখনো জানে না, ওর বাবা আর জীবিত নাই। ধারদেনা করে দালালের কাছে ১৫ লাখ টাকা দিছি। বেঁচে থাকার মতো এখন আর কিছু নাই। আমাদের সঙ্গে কেন এমনটা ঘটল। সবাই তো শুনি সাগর পাড়ি দিয়া ইতালি পৌঁছে যাচ্ছে। আমার স্বামীর সঙ্গে কেন এমনটা ঘটল? আমার স্বামীর মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচার চাই।’
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া অভিযুক্ত দালালকে ধরতে তাঁদের অভিযান অব্যাহত আছে। মানব পাচার রোধে সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে। দালালের খপ্পরে না পড়ে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।