করোনার পর ৪০ ভাগ রোগীর ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত, নোয়াখালীতে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা

করোনা সংক্রমণের সময় ৪০ শতাংশ রোগীর ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। নিয়মিত ফলোআপে না থাকা, হাঁটাচলা বন্ধ করে দেওয়ায় এবং সর্বোপরি ওষুধ সেবন না করার কারণে এই জটিলতা দেখা দেয় বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। করোনা মহামারিতে ডায়াবেটিস রোগীদের ওপর লকডাউনের প্রভাব শীর্ষক গবেষণাটি হেলথকেয়ার জার্নালে এ বছরের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়েছে।

এদিকে গত এক বছরে নোয়াখালীতে নতুন ডায়াবেটিস রোগী শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ১৫০ জন। এই সংখ্যা যাঁরা হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে এসেছেন তাঁদের। বাস্তবে এক বছরে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা হবে আরও অনেক বেশি হবে বলে চিকিৎসকেরা মনে করছেন।

ডায়াবেটিস–সংক্রান্ত গবেষণাটির নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) অ্যান্ডোক্রাইনোলজি ও হরমোন বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ফারহানা আকতার। এ ছাড়া গবেষণায় যুক্ত ছিলেন আইসিডিডিআরের গবেষক আহসানুল হক ও যুক্তরাজ্যের স্ট্রাথলাইড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ব্রায়ান গডম্যান।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৭৩০ ডায়াবেটিস রোগীর ওপর এই গবেষণা হয়। ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত লকডাউন ও লকডাউন–পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ওপর এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ৫০৪ জন নারী ও ২২৬ জন পুরুষ। ৩০ বছরের নিচে রোগী ছিল ৪ শতাংশ। ৩১ থেকে ৫০ বছর বয়সী ছিল ৪৪ শতাংশ। ৫১ বছরের বেশি রোগী ছিল ৫০ শতাংশ।

গবেষণায় রোগীদের কোভিড-১৯–এর আগে থেকে পাঁচটি চিকিৎসাবিষয়ক ফলোআপ পর্যালোচনা করা হয়। এর মধ্যে দেখা যায়, ৯০ ভাগ রোগীর ডায়াবেটিস হলেও তাঁরা চিকিৎসক কিংবা হাসপাতালের শরণাপন্ন হননি। আবার প্রথমবার চিকিৎসা নেওয়ার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার চিকিৎসকের কাছে গেছেন যথাক্রমে ২ ও ৩ শতাংশ রোগী। পঞ্চমবারে ৭০ শতাংশ বা ৫১০ জন রোগী চিকিৎসক বা হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন। কোভিড-১৯ তত দিনে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

গবেষণায় বলা হয়, প্রথম পরিদর্শনে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস পাওয়া যায় মাত্র ৪১ জনের বা সাড়ে ৫ শতাংশের। কিন্তু কোভিডের পর পঞ্চম পরিদর্শনে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস পাওয়া যায় ২৯৩ জনের। এটা মোট রোগীর ৪০ শতাংশ। এসব রোগীর রক্তে শর্করা (ব্লাড সুগার), রক্তচাপ অতিমাত্রায় বেশি পাওয়া যায়। এ ছাড়া ক্রিয়েটিনিন (কিডনির কর্মক্ষমতা কমার নির্দেশক) বেড়ে যায়। আবার ৪০ শতাংশ রোগীর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু পঞ্চমবারে ২৭ জন রোগী ফলোআপে আসেননি।

জানতে চাইলে সহযোগী অধ্যাপক ফারহানা আকতার বলেন, কোভিড–পরবর্তী সময়ে এতই জটিলতা বেড়েছে যে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়েছেন অনেক রোগী। এ ছাড়া স্ট্রোক করেছেন কেউ কেউ। আবার অনেককে দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।

গবেষকদের মতে, কোভিড-১৯–এর সময় স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হয়েছিল। অনেক রোগী ভয়ে হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে যাননি। এ কারণে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। হাঁটাচলা ও ওষুধ সেবন করেননি, খাদ্যাভ্যাস ঠিক রাখেননি তাঁরা। ওজন বেড়ে যায় অনেকের। এমনকি চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রও সংরক্ষণ করেননি অনেকে। যার কারণে পরবর্তী সময়ে চিকিৎসা দিতে গিয়ে রোগীর অতীত রেকর্ডপত্র পাওয়া যায়নি।

তবে এই গবেষণায় দেখা যায়, কোভিডের সময় জনপ্রিয়তা পেয়েছে টেলিমেডিসিন সেবা। একই সেবা কোভিড–পরবর্তী দূরদূরান্তের রোগীদের ক্ষেত্রেও পরিচালিত হয়ে আসছে বলে গবেষকেরা উল্লেখ করেছেন। এই সেবার আরও প্রসার করা যায় বলে মনে করছেন তাঁরা। পাশাপাশি রোগীদের রেকর্ডপত্র সংরক্ষণের জন্য ডেটাবেজ বা কম্পিউটারাইজড পদ্ধতির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন গবেষকেরা। রেকর্ড না থাকলে ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসা ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে যায় বলে তাঁরা জানান।

নোয়াখালীতে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা
নোয়াখালীতে বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। গত এক বছরে জেলায় নতুন ডায়াবেটিস রোগী শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ১৫০ জন। এই সংখ্যা যাঁরা হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে এসেছেন তাঁদের। বাস্তবে এক বছরে ডায়াবেটিক আক্রান্তের সংখ্যা হবে আরও অনেক বেশি বলে চিকিৎসকদের ধারণা। আজ মঙ্গলবার সকালে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষে সমিতি আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসব তথ্য উপস্থাপন করেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আলম আজাদ।

দিবসটি উপলক্ষে সকালে ডায়াবেটিক হাসপাতাল চত্বরে দিনব্যাপী ডায়াবেটিক মেলা, কেক কাটা, শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন সমিতির সভাপতি জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান।

ডায়াবেটিক সমিতির জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক দিদারুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী ডায়াবেটিক সমিতি পরিচালিত হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৫০ জন রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।

সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আলম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ২০০১ সাল থেকে নোয়াখালী ডায়াবেটিক সমিতির মাধ্যমে ডায়াবেটিক রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত সমিতিতে চিকিৎসা নেওয়া নিবন্ধিত রোগীর সংখ্যা ৪১ হাজার ৩২ জন। এর মধ্যে গত এক বছরে নতুন রোগী বেড়েছে ১ হাজার ১৫০ জন। নতুন ও পুরোনো রোগীর মধ্যে ৩০০ জন শিশু রয়েছে। যাদের মধ্যে নবজাতক শিশুও রয়েছে।