চার মাস ধরে ঘরে পানি নেই চৌমুহনী পৌরসভার বাসিন্দাদের

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনী পৌরসভার পানি সরবাহের একটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। পৌরসভার চৌরাস্তা এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে পানির বিল পরিশোধ করেন পারভীন আক্তার। এরপরও তিন-চার মাস ধরে পৌরসভার পানি পাচ্ছেন না। এ কারণে রাগ করে পানির লাইনই খুলে রেখেছেন। খাওয়ার পানি কিনে খাচ্ছেন বাজার থেকে। আর গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করছেন পাশের পুকুরের ময়লা পানি। এতে করে পরিবারের সদস্যদের অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে।

এই সমস্যা শুধু পারভীন আক্তারের বাড়িতে নয়। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী পৌরসভার প্রায় চার হাজার গ্রাহক পানির অভাবে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। তিন-চার মাস ধরে পানির এ-সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

ভূগর্ভের পানির স্তর নেমে যাওয়া, পাম্পের স্বল্পতা, লোডশেডিং, সরবরাহ লাইনের সমস্যার কারণে চৌমুহনী পৌরসভায় সুপেয় পানি সরবরাহব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে। সংকট দূর করার বিষয়ে পৌর কর্তৃপক্ষ বাসিন্দাদের তেমন কোনো সুখবরও দিতে পারছে না। এ নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশায় রয়েছেন পৌরসভার ৩ হাজার ৮৩১ জন গ্রাহক।

বাড়ির সরবরাহ লাইনে পানি না থাকায় কাঁধে গামছা ও হাতে সাবান নিয়ে বাড়ি থেকে প্রায় ৫০০ গজ দূরের পুকুরে গোসল করতে যাচ্ছিলেন চৌমুহনী পৌরসভার করিমপুরের আলী মিয়ার বাড়ির বাসিন্দা মোহাম্মদ ইসমাইল। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, প্রায় এক মাসের বেশি সময় ধরে এক ফোঁটা পানিও আসেনি লাইনে। তিনি পুরুষ হওয়ায় দূরে গিয়ে গোসল করতে পারছেন। কিন্তু নারীদের অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁরা পানির অভাবে ঠিকমতো গোসলও করতে পারেন না।

পানি সরবরাহ শাখা থেকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চৌমুহনী পৌরসভার পানি সরবরাহের মোট লাইন ১২৪ দশমিক ২ কিলোমিটার। পানি সরবরাহের সক্ষমতা ৫৮ লাখ ৯৫ হাজার লিটার। পানি উত্তোলনের জন্য বিভিন্ন এলাকায় ১৫টি পাম্প বসানো হয়েছে। এসব পাম্পের মাধ্যমে উত্তোলিত পানি নেওয়া হয় কলেজ রোড, হাজীপুর ও চৌরাস্তা এলাকার তিনটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে। সেখানে পানি থেকে লোহা দূরীকরণের পর তা পাইপলাইনে গ্রাহকদের মধ্যে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা হয়, তা দিয়ে পৌরসভার চাহিদার মাত্র ৬৫ শতাংশ সরবরাহ করা সম্ভব হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পৌরসভার একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পানি সরবরাহের যেটুকু সামর্থ্য পৌরসভার রয়েছে, সেটুকুও যথাযথভাবে কাজে লাগানো হয় না। তা ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে পাইপলাইন বসানোর কারণে কোনো এলাকার গ্রাহক পানি পান, কোনো এলাকায় মোটেই পানি পাওয়া যায় না। আবার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মূল পাইপলাইনের সঙ্গে অবৈধভাবে পাম্পের সংযোগ দিয়ে সরাসরি পানি তুলে নেন। এতে সাধারণ গ্রাহকের কাছে আর পানি পৌঁছায় না। অবৈধ ওই সব সংযোগের সঙ্গে পৌরসভার লোকজনও জড়িত।

করিমপুর এলাকার আরেক বাসিন্দা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, পৌরসভার পানি এখন তাদের কাছে সোনার হরিণের মতো। অথচ মাস শেষে পানির বিল ঠিকই নিচ্ছে পৌর কর্তৃপক্ষ। আগে কিছু কিছু পানি পাওয়া গেলেও টানা তিন-চার মাস ধরে কোনো রকম পানি পাওয়া যায়নি। পানিসংকটে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম কষ্টে দিন কাটছে তাঁদের। সমস্যার বিষয়ে পৌরসভার মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বারবার জানালেও তাঁরা কোনো ভ্রুক্ষেপ করছেন না।

আগে এলাকায় প্রায় প্রতি বাড়িতেই পুকুর ছিল, পানিও ভালো ছিল। এখন সব পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। যেগুলো আছে, সেগুলোর পানি ব্যবহার করার মতো নয়। তবু উপায় না দেখে ওই দূষিত পানি দিয়ে ঘরের কাজ করছেন বলে জানান পৌরসভার বাসিন্দা আসমা আক্তার। তিনি বলেন, চৌমুহনী এলাকার পাতালের (ভূগর্ভের) পানিতে অতিরিক্ত লবণ। বাসা-বাড়িতে পাম্প বসিয়ে ওই পানি তোলা হলেও তা খাওয়ার কাজে ব্যবহার করা যায় না। খাওয়ার জন্য পানি কিনতে হচ্ছে এখন।

পানির লাইন আছে। পড়ে আছে পানির ড্রাম। তবে মাসের পর মাস পানি না আসায় পাইপের মুখের কল খুলে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনী পৌরসভার করিমপুর এলাকায়।
ছবি: প্রথম আলো

পৌরসভার পানি শাখার সহকারী প্রকৌশলী মিনহাজ আহমেদ বলেন, ভূগর্ভের পানি উত্তোলনের জন্য গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ ফুট গভীরে পাইপ বসানো হয়েছে। কিছুদিন পানি উত্তোলনের পর দেখা যায়, ওই স্তরে আর পানি নেই। বর্তমান পানিসংকট দূর করতে হলে আরও উৎপাদন পাম্প বসানো প্রয়োজন। সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টও। পৌরসভার গ্রাহকদের কাছ থেকে যে রাজস্ব আদায় হয়, তা দিয়ে নতুন প্ল্যান্ট কিংবা লাইন কোনোটাই করা সম্ভব নয়। সরকারিভাবে বড় প্রকল্প নেওয়া হলে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।

পৌর মেয়র খালেদ সাইফুল্যাহ পানিসংকটের বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাতালে (ভূগর্ভে) পানি না থাকলে আমি কী করব? তা ছাড়া লোডশেডিংয়ের কারণে ঠিকমতো পানি উত্তোলন করা যায় না। আবার পাইপলাইনেও সমস্যা রয়েছে। নতুন আরও পাম্প, ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রয়োজন। অনেক গ্রাহক আছেন, যাঁরা ঠিকমতো পানির বিল দেন না। পৌরকর দেন না। পৌরসভার যে আয়, তা দিয়ে ঠিকমতো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়াও কষ্টকর। তবে পানির সমস্যা দূর করতে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে তিনি একটি বড় প্রকল্প হাতে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। সেটা সফল হলে এই সংকট থাকবে না।’