ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ঘেঁষে একের পর এক অঘোষিত ভাগাড়, বর্জ্য ফেলে পরিবেশদূষণ
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের হাড়াতলী এলাকা। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার এই এলাকায় গেলে দূর থেকেই নাকে ভেসে আসে উৎকট দুর্গন্ধ। মহাসড়কের ঢাকামুখী লেনের পাশে চোখে পড়ে সারি সারি ময়লার স্তূপ। মহাসড়কের পাশ যেন হয়ে উঠেছে ময়লা-আবর্জনা ফেলার ভাগাড়ে।
শুধু হাড়াতলী এলাকাই নয়; ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের বেশ কয়েকটি স্থানে এমন অঘোষিত ভাগাড় গড়ে উঠেছে। মহাসড়কের প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে কুমিল্লা জেলার অংশ। এর মধ্যে অন্তত ২০টি স্থানে একইভাবে ময়লা ফেলা হচ্ছে। কোথাও কোথাও সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান মহাসড়কের পাশে তাদের সংগ্রহ করা ময়লা ফেলছে। এতে মহাসড়কের পাশে বিভিন্ন স্থানে আবর্জনার স্তূপ দিন দিন বাড়তে, মহাসড়ক পরিণত হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা ফেলার ভাগাড়ে। এভাবে পরিবেশদূষণ বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদীরা।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লার সভাপতি মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে বর্জ্য ফেলার কারণে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যদি সঠিকভাবে করতে না পারে, তাহলে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের কাজটা কী? মানুষ তো ট্যাক্স দেয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য। এভাবে ময়লা-আবর্জনা ফেলা একধরনের অপরাধও। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে এসব বিষয়ে কঠোর হওয়া দরকার।
হাড়াতলী এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, প্রায় দুই বছর আগে স্থানটিতে ময়লা ফেলা শুরু করে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন। এরপর সেটি ধীরে ধীরে পরিণত হয় ভাগাড়ে। দিন যত গেছে, ময়লা ফেলার জায়গাটির আকার ততই দীর্ঘ হয়েছে। এ কারণে ওই স্থান দিয়ে হেঁটে চলাচল করা বেশ দুষ্কর হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন আশপাশের বসবাসকারীরা। ভাগাড়ের আশপাশে অন্তত তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও ময়লার দুর্গন্ধে নাকাল।
এভাবে পরিবেশদূষণ বন্ধে আমরা দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করছি। তবে এ বিষয়ে মূল দায়িত্বটা পালন করতে হবে সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদকে।
স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ময়লা ফেলতে আমরা বারবার বাধা দিয়েছি, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। সিটি করপোরেশন সবুজে ঘেরা এলাকাটির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এখনো প্রতিদিন ময়লা বাড়ছে। সিটি করপোরেশন বলে, তারা নাকি এখন ময়লা ফেলে না। তাহলে আমাদের প্রশ্ন, ময়লা কারা ফেলছে?’
স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী তাহমিনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, শ্রেণিকক্ষে বসা যায় না দুর্গন্ধের জন্য। একটু বাতাসেই নাকে ভেসে আসে ময়লার দুর্গন্ধ। কলেজে প্রবেশের সময় নাক চেপে ধরে আসতে হয়। এ ছাড়া পরিবেশও মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।
জানতে চাইলে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, হাড়াতলীতে তিন মাস ধরে তাঁরা আবর্জনা ফেলছেন না। সিটি করপোরেশনের ফেলা ময়লাগুলো ভেকু দিয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এখন রাতের আঁধারে আশপাশের লোকজন এবং বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মহাসড়কের পাশে ময়লা ফেলছে। যারা ময়লা ফেলছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে চৌদ্দগ্রাম পৌর এলাকার প্রবেশমুখ বালুজুরী এলাকায় মহাসড়কের উভয়মুখী লেনের পাশেই আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। প্রায় ৪০০ মিটার এলাকাজুড়ে আবর্জনা ফেলার কারণে চলাচলের সময় চালক ও যাত্রীদের নাক চেপে ধরে রাখতে হয় তীব্র দুর্গন্ধের কারণে।
চৌদ্দগ্রাম পৌর এলাকার বাসিন্দা আসিফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দুই দশকের বেশি সময় ধরে এখানে ময়লা ফেলছে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। এতে পরিবেশদূষণ চরম আকারে পৌঁছেছে। কয়েক দিন পর এসব ময়লার মধ্যে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তখন বায়ুদূষণ আরও বেড়ে যায়।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জামাল হোসেন বর্তমানে পৌরসভার প্রশাসকের পদে রয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই পৌরসভার আবর্জনা ফেলার জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু সেভাবে জায়গা না পাওয়ায় আপাতত মহাসড়কের পাশে ফেলা হচ্ছে।
চান্দিনা উপজেলা পরিষদের রাস্তার প্রবেশমুখে ধানসিঁড়ি এলাকাতেও মহাসড়কের পাশে ময়লার স্তূপ দেখা গেছে। সেখানে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ময়লা ফেলছে চান্দিনা পৌরসভা। জেলার বুড়িচং উপজেলার নিমসার বাজার এলাকায় মহাসড়কের পাশে সারি সারি ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। দেশের অন্যতম বৃহৎ এই সবজি বাজারের বেশির ভাগ আবর্জনা ফেলা হচ্ছে মহাসড়কের পাশে। কুমিল্লা সেনানিবাস-সংলগ্ন নাজিরা বাজার এলাকায়ও মহাসড়কের পাশে আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। দাউদকান্দি উপজেলার তালতুলী, গৌরীপুরসহ কয়েকটি এলাকায় মহাসড়কের পাশে ময়লার স্তূপ দেখা গেছে।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক মোসাব্বের হোসেন মোহাম্মদ রাজীব প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে পরিবেশদূষণ বন্ধে আমরা দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করছি। তবে এ বিষয়ে মূল দায়িত্বটা পালন করতে হবে সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদকে। কারণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বটা তাঁদের। সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে সওজকে; কারণ মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তাঁদের দায়িত্ব।’
এ প্রসঙ্গে সড়ক ও জনপথ বিভাগ, কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহাসড়কের পাশে ময়লা না ফেলতে আমরা বিভিন্ন বাজার কমিটি ও সংশ্লিষ্ট পৌরসভাগুলোকে চিঠি দিয়েছি, বিভিন্নভাবে সতর্ক করেছি। এরপরও তাঁরা ময়লা ফেলা বন্ধ করছেন না। আমরা মহাসড়কের পাশে ময়লা ফেলা বন্ধের জন্য কাজ করছি। ভবিষ্যতে এসব বিষয়ে আমরা কঠোর হব। তবে যাঁরা ময়লা ফেলছেন, তাঁদেরই পরিবেশদূষণের বিষয়ে আগে সচেতন হওয়া জরুরি।’