‘কী ইলেকশন আইছে রে, আমার মানিকরে মাইর‍্যা ফ্যালাইলো’

গোপালগঞ্জের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের সামনে বুধবার ওসিকুরের বোনের কান্না
ছবি: প্রথম আলো

গোপালগঞ্জের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের মর্গের সামনে দাঁড়ানো এক ইজিবাইকে বসে আজ বুধবার সকালে কাঁদছিলেন জবেদা বেগম। মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন ওই গ্রামের আরও শতাধিক লোক। তাঁরা এসেছেন ওসিকুর ভূঁইয়ার (২৭) লাশ নিতে। এক দিন আগেই তিনি সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতায় নিহত হয়েছেন।

জবেদার কণ্ঠে নির্বাচন নিয়ে আক্ষেপ ঝরে পড়ল। তিনি বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘ওরে ইলেকশন আমার বাবারে নিয়ে গ্যালো। কী ইলেকশন আইছে রে, আমার মানিকরে মাইর‍্যা ফ্যালাইলো। তোরা আমার বাবাকে আইনে দে। আমার বাবারে এহনো তোরা এহানে রাখছিস ক্যা? তোরা আমার আব্বারে নিয়ে চল। আমার ওসিকুরের ছোট একটা ছেলে (চার মাস), তাকে কে দেখবে?  আমাকে কে বাজার করে খাওয়াবে?’

গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার চন্দ্রদিঘলিয়া বাজারে গুলিতে ওসিকুরসহ পাঁচজন আহত হন। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। নিহত ওসিকুর ভূঁইয়া (২৭) গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামের জলিল ভূঁইয়ার ছেলে। তিনি চন্দ্রদিঘলিয়া বাজারে চা বিক্রেতা ছিলেন।

পরিবারের লোকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওসিকুরের উপার্জনে চলত পাঁচ সদস্যের পরিবার। তিনি এক বেলা রাজমিস্ত্রির সহযোগীর কাজ করতেন, অন্য বেলা চায়ের দোকানে চা বিক্রি করতেন। সেই টাকা দিয়েই চলত মা–বাবা, স্ত্রী ও এক সন্তানের সংসার। পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে দিশেহারা পরিবার।

আরও পড়ুন

এলাকার লোকজন বলেন, সদর উপজেলা নির্বাচনে আটজন প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাঁদের মধ্যে দুজন প্রার্থী ছিলেন উপজেলার চন্দ্রদিঘলিয়া ইউনিয়নের চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামের। ওই দুই প্রার্থীর মধ্যে কামরুজ্জামান ভূঁইয়া ১ হাজার ৪৯০ ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন গ্রামের বি এম লিয়াকত আলি। সহিংসতার সূত্রপাত মূলত সেখান থেকেই। গ্রামে লিয়াকত আলীর পক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করেন ছবেদ আলি ভূঁইয়া। আর অপর পক্ষের নেতৃত্ব দেন কামরুজ্জামান ভূঁইয়া ও কালু ভূঁইয়া। কালু ভূঁইয়া কামরুজ্জামানের ছোট ভাইয়ের শ্বশুর (তালুই)। ওসিকুর লিয়াকত আলীর সমর্থক ছিলেন। আর হামলাকারীরা বিজয়ী প্রার্থী কামরুজ্জামান ভূঁইয়ার সমর্থক ছিলেন।

হাসপাতালের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় ছবেদ আলী ভূঁইয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড ছিল পূর্বপরিকল্পিত। আমি একটা দলের নেতৃত্ব দিই। আমাদের প্রার্থী ছিল লিয়াকত আলি। আমাদের লোকজনকে কামরুজ্জামান ভূঁইয়ার পক্ষে নেওয়ার জন্য জোরজুলুম করা হয়। নির্বাচনী ফলাফল ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও আমরা চুপচাপ ছিলাম। গতকাল তারা পূর্বপরিকল্পিতভাবে আমাদের লোকের ওপর আক্রমণ করে।’

আরও পড়ুন

অভিযোগের বিষয়ে কামরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, নির্বাচনের সময় পক্ষ-বিপক্ষ ছিল। তবে তাঁরা কেউ গন্ডগোল করেননি। তিনি তিন দিন আগে ঢাকায় এসেছেন। এ ঘটনায় কেউ সম্পৃক্ত নয়। এটা রাতের আঁধারে ঘটেছে। কে বা কারা ঘটিয়েছে, তা তাঁরা জানেন না। তবে ওই ঘটনার পর মাইকিং করে কয়েক শ লোক সংঘবদ্ধ হয়ে তাঁদের বাড়ি ও কার্যালয় ভাঙচুর করেন।

ওসিকুরের লাশ নিতে আসা কয়েকজন বলেন, নির্বাচন শেষ, ফলাফলও হয়ে গেছে। কিন্তু দুই পক্ষের সহিংসতায় ওসিকুর মারা গেলেন। তাঁর পরিবার এখন কীভাবে চলবে? তাঁর পরিবারকে সহায়তা করতে প্রশাসনের এগিয়ে আসা উচিত।