রাজশাহীর বেশির ভাগ আমবাগানে পোকার আক্রমণ

রাজশাহীতে এবার ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। এবার বেশির ভাগ আমবাগানে কমবেশি পোকার আক্রমণ হয়েছে।

খরা ও পোকার আক্রমণে ঝরে পড়ছে আম। গত বুধবার রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়পাড়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো

রাজশাহীতে এবার গাছে আম কম দেখা যাচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক নানা কারণে ৬০ শতাংশ গাছেই আম নেই বলে কৃষকেরা দাবি করেছেন। এখন নতুন বিপদ পোকার আক্রমণ। এতে যে আম আছে, সেই আম রক্ষা করাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। জেলায় প্রায় সব আমবাগানেই কমবেশি পোকার আক্রমণ হয়েছে।

কৃষকেরা বলেন, আম রক্ষায় অনুমোদিত মাত্রায় ওষুধ ছিটিয়েও কাজ হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে চাষিরা অতিরিক্ত মাত্রায় ওষুধ ছিটাচ্ছেন। পোকার আক্রমণের এবার আমের উৎপাদন কম হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছর জেলায় ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছিল। এবার ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। তাদের হিসাবমতে, ৮৫ শতাংশ গাছে আমের মুকুল এসেছে।

রাজশাহী জেলার বেশির ভাগ আমের বাগান চারঘাট ও বাঘা উপজেলায়। বাঘা উপজেলার বড় আমচাষি সাদি এন্টারপ্রাইজ কয়েক বছর ধরে বিদেশে আম রপ্তানি করছে। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আসাফুদ্দৌলা বলেন, এবার বেশির ভাগ গাছে কোনো আম নেই। ওই সব চাষি গাছের কোনো পরিচর্যা করছেন না। ফলে পোকামাকড় যে গাছে আম আছে, সেই গাছেই হামলা করছে। কীটনাশক ছিটানোর এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার অন্য বাগান থেকে এসে আক্রমণ হচ্ছে। উপর্যুপরি এই আক্রমণের ফলে অনুমোদিত মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ করে কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, এখন বাগানে মাছি পোকা, লেদা পোকানাশক বিষ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।

এবার ভালো আম ধরেছে বাঘা উপজেলার আড়পাড়া গ্রামের বড় আমচাষি আনোয়ার হোসেনের বাগানে। শুক্রবার দুপুরে তাঁর বাগানে গিয়ে দেখা যায়, তিনটি ড্রাম থেকে মেশিনের মাধ্যমে তিনি তাঁর আমগাছে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। কীটনাশক ছিটানোর জন্য তিনি বিশেষ আয়োজন করেছেন। এভাবে কেন কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে, জানতে চাইলে আনোয়ার হোসেন বলেন, হপার পোকা তাঁর আমের অনেক ক্ষতি করেছে। এখন নতুনভাবে আম ছিদ্রকারী পোকা উড়ে এসে হুল ফুটিয়ে চলে যাচ্ছে। এখন এই পোকার আক্রমণ শুরু হয়েছে।

ওষুধের গুণগত মান কমে গেছে। অল্প মাত্রায় কাজ হচ্ছে না। আবার দামও বেড়ে গেছে ৩০ শতাংশ। সব গ্রুপের ওষুধের দাম বেড়ে গেছে। শ্রমিকের দাম বেড়েছে। চাষিরা শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই জন্য মানুষ আমগাছ কেটে অন্য আবাদে যাচ্ছেন। যাঁদের কম জমি, তাঁরা শেষ হয়ে যাবেন।

 বাঘা উপজেলার গড়গড়ি এলাকার বড় আমচাষি স্বপন সরকারের পৌনে ৯০০ আমগাছে এবার আম এসেছে। তিনিও বলছেন, গাছে কীটনাশক দিতে দিতে তিনি হয়রান হয়ে যাচ্ছেন। তেমন কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, হপার দমনের জন্য সাধারণত ১৫ দিন পরপর কীটনাশক ছিটানোর কথা। কিন্তু পোকার আক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় পাঁচ দিন পরই কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে। তা ছাড়া আম বাঁচানো যাবে না।

রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও শাহ কৃষি পাঠাগার ও জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা জাহাঙ্গীর শাহর আমবাগান রয়েছে রাজশাহীর পাশের জেলা নওগাঁর মান্দা উপজেলার কালীগ্রামে। তিনি বলেন, অনুমোদিত মাত্রার বাইরে তিনি ওষুধ ব্যবহার করেননি। তাঁর শ্রমিকেরা তাঁকে আগেই সতর্ক করেছিলেন যে শুধু অনুমোদিত মাত্রায় ওষুধ দিয়ে পোকার আক্রমণ থেকে আম বাঁচানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছে। তাঁর বাগানের সব আম পোকায় শেষ করে দিয়েছে।

রাজশাহী ফল গবেষণাকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, তাঁদের কাছে কোনো চাষি অভিযোগ করেননি। তবে এবার গাছে আম গতবারের চেয়ে অনেক কম আছে। কয়েক দিন আগের বৃষ্টিতে আমের বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। এখন ফল ছিদ্রকারী পোকার উপদ্রব হতে পারে। এই ক্ষেত্রে প্রথম দিকে যে কটি আম ছিদ্র হয়, সেগুলো গাছ থেকে নামিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলা দরকার। তা ছাড়া ওই নষ্ট আম থেকে কষ বের হয়ে অন্য আমেও সংক্রমণ হয়। এই পোকার জন্যও তাঁরা নির্ধারিত ওষুধের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষক কর্মকর্তা উম্মে সালমা বলেন, আমের যত মুকুল আসে, তত আম হলে গাছ তো ধরে রাখতেই পারবে না। অল্প যে মুকুল থাকে, তাতে আম এলেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়। পোকার উপদ্রব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন তো হপার পোকা ও অ্যানথ্রাকনোজ নামের একটা ছত্রাকের সংক্রমণ থেকে আম রক্ষার জন্য তাঁরা অনুমোদিত কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। তাতেই কাজ হওয়ার কথা। তা ছাড়া এখন খরা শুরু হয়েছে। চাষিরা সেচ দেবেন, মালচিং করবেন, বিকেলে বা সন্ধ্যায় গাছে পানি স্প্রে করবেন। এতেই কাজ হবে।