গরম কাপড় পেতে রাত জেগে অপেক্ষা তাঁদের

কয়েক দিন ধরে তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। এই শীতে নিম্ন আয়ের লোকজন সবচেয়ে দুর্ভোগে। 

শীতের কাপড়ের জন্য অপেক্ষা করছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। গত মঙ্গলবার রাত দেড়টার দিকে গাজীপুরের জয়দেবপুর রাজবাড়ী সড়কের পাশের কেআইবি মার্কেটের সামনেছবি: প্রথম আলো

গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টা। মাঘের হিম বাতাস। জড়সড় অবস্থা। গাজীপুরের জয়দেবপুর রেলস্টেশনের ফটকে জনা পাঁচেক নারীর জটলা। পরনে অপরিচ্ছন্ন পোশাক, কারও খালি পা। তাঁদের বয়স ৫০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। রাত জেগে অপেক্ষা করছেন শীতের কম্বলের জন্য।

এর মধ্যেই পাওয়া গেল ষাটোর্ধ্ব আমেনা বেগমকে। কুঁজো হয়ে বসেছিলেন ফটকের এক কোণে। বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায়। স্বামী মারা গেছেন চার বছর হলো। একমাত্র ছেলে অসুস্থ। তাঁর নিজের সংসার চলে না। আমেনা বাধ্য হয়ে চলে এসেছেন গাজীপুরে। জীবনধারণের জন্য বেছে নিয়েছেন ভিক্ষাবৃত্তি। সারা দিন ভিক্ষা করে রাতে ঘুমান স্টেশনে, খোলা আকাশের নিচে।

কয়েক দিনের তীব্র শীত কেড়ে নিয়েছে আমেনার চোখের ঘুম। কখনো দিনভর ঘন কুয়াশা, কখনো সকালের হিম বাতাসের মধ্যেই চরম কষ্টে শীত পার করছেন। নেই গরম কাপড়, বিছানা। তাই একটা গরম কাপড় বা কম্বল পেতে রাত জেগে অপেক্ষা করছিলেন স্টেশনের মূল ফটকে। আমেনা বলেন, ‘শীতের যন্ত্রণায় রাইতে ঘুমাইতে পারি না। বিছানার নিচ থেইক্যা টান্ডা ওডে। আর ওপর থেইক্যা ঘন কুয়াশা পইড়্যা কাপড় ভিইজ্যা যায়। সারা রাত বইস্যা কাডাই। হুনছি প্রতি রাইতে প্রশাসনের লোকজন আইস্যা কম্বল দেয়। হেললাইগ্যা সন্ধ্যা থেইক্যা বইস্যা রইছি। কিন্তু এহনো কেউ আহে নাই।’

আমেনার পাশেই একটি পাতলা ওড়না মুড়ি দিয়ে বসে ছিলেন সখিনা বেগম। বাড়ি নেত্রোকানায়। স্বামী নেই। গাজীপুরে থাকেন এক আত্মীয়ের বাসায়। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। তিনি অন্যের বাসায় কাজ করেন। যা আয়, তা দিয়ে নিজে চলেন, সন্তানকে লেখাপড়া করান। কম্বলের আশায় তিনিও ছুটে এসেছেন স্টেশনে।

সখিনা বলেন, ‘মানুষের বাসায় কাজ করে যে ট্যাকা পাই, তা দিয়ে নিজেরাই চলতে পারি না। প্রতি মাসে ধারদেনা করা লাগে। গ্রামের বাড়ি থেইক্যা সন্তানেরা ফোন করে শীতের গরম কাপড় চায়। কিন্তু ট্যাকার অভাবে কাপড় কিনতে পারি না। এর মধ্যেই একজন কইল, স্টেশনে গেলে গরম কাপড় পাওয়া যায়। হেললাইগ্যা স্টেশনে আইছি। সন্ধ্যা থেইক্যা বইস্যা রইছি। কিন্ত আসে নাই। এর আগেও দুই রাইত স্টেশনে বইস্যা ছিলাম। কিন্তু কাপড় পাই নাই।’

সখিনার সঙ্গে কথা বলার শেষের দিকে হঠাৎ একটি প্রাইভেট কার এসে থামে স্টেশনের ফটকে। সখিনা কথা শেষ না করেই ছোটেন প্রাইভেট কারের দিকে, সঙ্গে আমেনাও। তাঁদের দেখে ছুটে আসেন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে থাকা আরও চার–পাঁচজন। কিন্তু ওই প্রাইভেট কারটি এসেছে যাত্রী নিয়ে। যাত্রী নামানো শেষে প্রাইভেট কারটি যথারীতি চলে যায়। মন খারাপ করে তাঁরা আবার বসে পড়েন যে যাঁর মতো।

প্রাইভেট কার দেখে এভাবে ছুটে গেলেন কেন, জানতে চাইলে সখিনার উত্তর, ‘যারা কম্বল দিবার আসে, তারা এলাকার ধনী লোক। পাশাপাশি প্রশাসনের লোকজনও গাড়ি নিয়া আসে। একলগে অনেক কম্বল নিয়া আহে তারা। ওই প্রাইভেট কার দেখেও ভাবছিলাম, কেউ কম্বল নিয়া আইছে, হেললাইগ্যা তাড়াতাড়ি গেসিলাম। কারণ, কেউ কম্বল নিয়া আসলে কাড়াকাড়ি লাইগ্যা যায়।’

জয়েদেবপুর রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে খানিকটা সামনে এগোলে শহরের রাজবাড়ী সড়ক। সড়কটি ধরে কিছুটা সামনে এগোলে হাতের বাঁয়ে কেআইবি মার্কেট। ঘড়ির কাঁটায় রাত প্রায় একটা। ক্রমেই বাড়ছিল কুয়াশা। এর মধ্যেই মার্কেটের সিঁড়িতে পাওয়া গেল আরও পাঁচ নারীকে। রাত জেগে তাঁদেরও অপেক্ষা শীতবস্ত্রের জন্য। তাঁদের একজন জরিনা আক্তার (৫৪), পেশায় ভিক্ষুক, থাকেন নগরের পূর্ব চান্দনা এলাকায়। জরিনা বলেন, ‘সারা দিন মানুষের কাছে চেয়েচিন্তে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পাই। ঘরভাড়া, সন্তানের লেখাপড়ার খরচ দেওয়ার পর আর কিছুই থাকে না। নিজের টাকায় কম্বল কেনার সাধ্য নাই। সে জন্য বাধ্য হয়েই শীতের কাপড়ের জন্য অপেক্ষা করছি। আমাগোর মতো গরিব মানুষের কপালে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই নাই।’