হাজারো পানকৌড়ি ও বকের ওড়াউড়ি ক্লান্তি ভোলায় পথিকের

ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ি আর বক আশ্রয় নিয়েছে গাছে। গত বৃহস্পতিবার যশোরের অভয়নগর উপজেলার জয়রাবাদ গ্রামে
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

পশ্চিম আকাশ রঙিন করে দিগন্তে ডুবছে সূর্য। অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভা ডানায় মেখে উড়ে চলেছে ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ি ও বক। দিনের ক্লান্তি শেষে তারা ফিরছে নীড়ে। তাদের কলকাকলিতে মুখর গোটা এলাকা। গোধূলিবেলায় কাজ শেষে মানুষের ঘরে ফেরার ব্যস্ততা। শত ব্যস্ততার মধ্যেও হাজারের ওপর পানকৌড়ি ও বকের ওড়াউড়ি আর কলরব প্রশান্তি এনে দেয় তাঁদের মনে।

১০ মে সন্ধ্যা ছয়টায় যশোরের অভয়নগর উপজেলার জয়রাবাদ গ্রামের খালপাড়ে গিয়ে এ দৃশ্যের দেখা মেলে। জয়রাবাদ গ্রামের পাশ দিয়ে কলকল শব্দে বয়ে চলেছে মুজুতখালী খাল। দক্ষিণ থেকে সোজা উত্তরে চলে গেছে খালটি। ভৈরব নদ থেকে বেরিয়ে প্রায় সাত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে খালটি আত্রাই নদের সঙ্গে মিশেছে। খালের পশ্চিম পাড়ে কয়েকটি বাড়ি। বাড়িগুলোর পশ্চিম পাশে সিদ্ধিপাশা–সোনাতলা-পেড়লী সড়ক। সড়কের পশ্চিম পাশে বিশাল বিল। খালপাড়ের ছোট বাড়িগুলো ছেয়ে আছে তেঁতুল, মেহগনি, জাম, কাঁঠাল ও নারকেলগাছে। গাছগুলোই পাখিদের নিরাপদ আবাস। গাছগুলোর ডাল ও পাতার ফাঁকে ফাঁকে শুধু পাখি আর পাখি।

গাছগুলোর ডাল ও পাতার ফাঁকে ফাঁকে শুধু পাখি আর পাখি। গত বৃহস্পতিবার যশোরের অভয়নগর উপজেলার জয়রাবাদ গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

সন্ধ্যা নামার আগেই ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ি আর বক বিলের দিক থেকে উড়ে আসতে থাকে গাছের দিকে। আশ্রয় নেয় গাছগুলোতে। পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। পাখির এমন কলরবে একটুও অতিষ্ঠ হন না আশপাশের বাড়ির লোকজন। উল্টো কেউ যেন পাখিগুলোর কোনো ক্ষতি করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখেন তাঁরা। তারপরও মাঝেমধ্যে শিকারিদের শ্যেনদৃষ্টি পড়ে পাখিগুলোর ওপর। এয়ারগান ও জাল নিয়ে শিকারিরা পাখি শিকার করতে আসেন।

খালপাড়ে পাশাপাশি দুটি বড় তেঁতুলগাছ। একটি তেঁতুলগাছ ভরে আছে পানকৌড়িতে, অন্যটি ভরে আছে বকে। তেঁতুলগাছের নিচে বাড়ি জয়রাবাদ গ্রামের সুরেশ বিশ্বাসের (৪৫)। তিনি বলেন, চার বছর আগে হঠাৎ করেই কিছু পাখি এখানে আশ্রয় নিতে শুরু করে। লোকজন তাদের বিরক্ত না করায় কিছুদিনের মধ্যে ওদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। প্রতি বছর বাড়ছে পাখি। ঝাঁক বেঁধে পাখিদের ওড়াউড়ির দৃশ্য আর কিচিরমিচির শব্দে মন ভরে যায়।

সন্ধ্যা নামার আগেই ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ি আর বক বিলের দিক থেকে উড়ে আসতে থাকে গাছের দিকে। গত বৃহস্পতিবার যশোরের অভয়নগর উপজেলার জয়রাবাদ গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

গৃহবধূ পূর্ণিমা সেন (৩২) বলেন, ফাল্গুন মাসের প্রথম দিকে পাখিগুলো আসতে শুরু করে। বাড়ির তেঁতুলগাছ, মেহগনিগাছে শত শত পাখি আশ্রয় নেয়। বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে। বাচ্চা ফোটায়। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে বাচ্চাসহ পাখিগুলো চলে যায়। পাখিগুলো এখানকার মানুষের অতিথি। তাঁরা পাখিদের আগলে রাখেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পাখিগুলোর কারণে তাঁদের কিছু সমস্যাও হয়। পাখিগুলো ঘরের চাল ও মাটিতে প্রচুর মলত্যাগ করে। পাখির মলে ঘরের টিনের চাল সাদা হয়ে গেছে। মল থেকে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ বের হয়। এ ছাড়া পাখিরা বিল থেকে মাছ ধরে এনে গাছে বসে খায়। মাছের কিছু অংশ ঘরের চাল ও মাটিতে পড়ে। এসব মাছের অংশ পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়। তবে এসব গায়ে মাখেন না বলে জানালেন সত্তরোর্ধ্ব শ্রীমতী বিশ্বাস।

প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে আগে পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। গত বৃহস্পতিবার যশোরের অভয়নগর উপজেলার জয়রাবাদ গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

সময় পেলে গ্রামে বেড়াতে আসেন খুলনার সরকারি ফুলতলা মহিলা কলেজের প্রভাষক অলিপ কুমার বিশ্বাস। পাখির দুষ্টুমি আর কিচিরমিচির তাঁকে আকৃষ্ট করে। ১০ মে সন্ধ্যায় তিনি এসেছিলেন পাখি দেখতে। অলিপ কুমার বলেন, গাছে গাছে পাখির ওড়াউড়ির দৃশ্য এবং কলকাকলিতে মুগ্ধ হতে হয়। সন্ধ্যায় পাখির ডাক ও ওড়াউড়ি এক ভিন্ন আবহ তৈরি করে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও মনে প্রশান্তি এনে দেয় পাখির কলকাকলি।