‘অসামাজিক’ কিছু দেখেননি স্থানীয় বাসিন্দারা, তারপরও মাইকে ঘোষণা দিয়ে হামলা

ময়মনসিংহ নগরের সুতিয়াখালী বাজারে ‘আত্তায়ে রাসুল চার তরিকা খাজা বাবার দায়রা শরিফ’ নামের খানকায় ভাঙচুরের সময় ভাঙা হয় হারমোননিয়াম। গতকাল শনিবার দুপুরে তোলাছবি: প্রথম আলো

আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বেহালা। পড়ে আছে একতারার ভাঙা অংশ। ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে হারমোনিয়ামসহ বাদ্যযন্ত্র ও গানের জিনিসপত্র। সরাজ, মন্দিরা, জিপসিসহ বাদ্যযন্ত্রগুলোতেই সুর উঠত। গাওয়া হতো সামা কাওয়ালি।

কিন্তু ‘অসামাজিক’ কার্যকলাপের অভিযোগ তুলে হামলা-ভাঙচুর করা হয়েছে ময়মনসিংহ নগরের ‘আত্তায়ে রাসুল চার তরিকা খাজা বাবার দায়রা শরিফ’ নামের ওই খানকায়। গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর এ ঘটনা ঘটে।

ময়মনসিংহ নগরের সুতিয়াখালী বাজারে প্রায় ১৭ বছর আগে সরকারি জমিতে ওই খানকা গড়ে তোলেন স্থানীয় উসমান গণি ফকির। গতকাল শনিবার দুপুরে খানকায় গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা স্থাপনা দেখতে ভিড় করেছেন অনেকে। টিনের খুপরিঘরের চারপাশ কুপিয়ে তছনছ করা হয়েছে। সিমেন্টের পিলারগুলো ভাঙা। পাশেই পড়ে আছে পুড়িয়ে দেওয়া গানের জিনিসপত্র। একটি সাউন্ড বক্স বাইরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মাইকগুলো ভাঙা। থালাবাসন, দানবাক্সসহ সব জিনিসপত্রই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

খানকা শরিফের খাদেম উসমান গণি ফকির বলেন, ১৭ বছর ৯ মাস ধরে তাঁকে কেউ বাধা দেয়নি। হঠাৎ শুক্রবার বেলা ১টা ৪০ মিনিটে কিছু দুর্বৃত্ত এসে ব্যাপক ভাঙচুর করে তাঁর ১০–১২ লাখ টাকার মালামাল নষ্ট করেছে। এখানে প্রতি শুক্রবার অনেক লোক এসে মিলাদ পড়ে। জিকির শেষে সামা কাওয়ালি গান হয়। তিনি শুনেছেন, মসজিদে ঘোষণা দিয়ে হামলা করা হয়। তিনি বলেন, ‘সরাজ, বেহালা, হারমোনিয়ামসহ গানের সব জিনিস ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কী কারণে হামলা করেছে, বুঝতে পারছি না। এখানে কোনো অসামাজিক কাজ হতো না। বাজারের ইজারাদারদেরও কোনো অভিযোগ ছিল না। মসজিদ কমিটিও কোনো দিন কিছু বলেনি। আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থাতেই আছি।’

মাইকে ঘোষণা দিয়ে হামলা

সুতিয়াখালী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও খানকা শরিফের দূরত্ব ৫০ গজের মতো। শুক্রবার জুমার নামাজের পর ইমাম মুসল্লিদের কাছ থেকে টাকা তুলতে মাইকে কথা বলেন। তখন ইমামের কাছ থেকে মাইক নিয়ে খানকা ভাঙার ঘোষণা দেন স্থানীয় রুবেল মিয়ার ছেলে মো. তানভীর (১৯)।

ময়মনসিংহ নগরের সুতিয়াখালী বাজারে ‘আত্তায়ে রাসুল চার তরিকা খাজা বাবার দায়রা শরিফ’ নামের খানকায় ভাঙা জিনিসপত্র ঘুরে দেখেন খাদেম উসমান গণি ফকির। গতকাল শনিবার দুপুরে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

বিষয়টি নিশ্চিত করে মসজিদের মোয়াজ্জিন নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেটি হুজুরের কাছ থেকে মাইক নিয়ে বলতে থাকে, ‘‘গনি মিয়ার মাজারটি আমরা ভাঙতে চাই। এখানে নষ্টামি হয়।’’ এই বলে মাইক্রোফোন রেখে চলে যায়। পরে নামাজ শেষে ভাঙচুরের শব্দ শুনে গিয়ে দেখি, অনেক ছেলেপেলে ভাঙছে। কিন্তু সেখানে মসজিদের কোনো লোক ও মুসল্লিদের সম্পৃক্ততা ছিল না।’

বাজারের ব্যবসায়ী রেজাউল করিম বলেন, ‘আমি বাজারের ব্যবসায়ী হয়ে কোনো দিন এখানে অসামাজিক কাজ দেখিনি। এটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভাঙা হয়েছে। কাজটি খুবই খারাপ হয়েছে। বাজারের লোক হিসেবে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার চাই।’

সুতিয়াখালী বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক আলীমুল আজিম বলেন, সমিতির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে খানকার কার্যক্রম চলছিল। অসামাজিক কার্যক্রমের কিছু তাঁরা দেখেননি। তেমন কিছু হলে সমিতির পক্ষ থেকে বন্ধ করে দেওয়া হতো। কিন্তু হঠাৎ জুমার নামাজ শেষে যে কায়দায় কাজটি করা হয়েছে, তাতে ব্যবসায়ীরা আতঙ্কগ্রস্ত।

আরও পড়ুন

দুই মাস আগে থেকে ভাঙার চেষ্টা

গতকাল দুপুরে ভাঙচুর হওয়া খানকা শরিফ ঘুরে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেওয়া তানভীরের বাড়িতে গিয়ে তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। এ সময় তানভীরের দাদি পরিচয় দেওয়া এক বৃদ্ধা বলেন, আজ সকালেও তানভীর বাড়িতে ছিল। কিন্তু এখন বাড়িতে কেউ নেই। তাঁর ছেলেও (তানভীরের বাবা) নেই। তিনি বলেন, ‘গতকাল বাজারে মাজার ভাঙচুর করা হয়েছে শুনেছি। এখানে আমার নাতি কী করেছে, বলতে পারছি না।’ তিনি ছেলে ও নাতির মুঠোফোন নম্বরও দিতে পারেননি।

ময়মনসিংহ নগরের সুতিয়াখালী বাজারে প্রায় ১৭ বছর আগে সরকারি জমিতে ওই খানকা গড়ে তোলেন স্থানীয় উসমান গণি ফকির
ছবি: প্রথম আলো

বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সেখানে আসেন স্থানীয় দুই তরুণ। তাঁদের মধ্যে উচ্চমাধ্যমিকে পড়া এক তরুণ বলেন, ‘আমরা দুই মাস ধরে এটি ভাঙার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। দুই-তিনবার সেখান গেলে সিনিয়রদের কারণে ভাঙা হয়নি। গতকাল শেষ পর্যায়ে আমরা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ভাঙচুর করেছি। বাজারের মধ্যে গভীর রাত পর্যন্ত গানবাজনার কারণে আশপাশের মানুষ ঘুমাতে পারে না। পাশে মসজিদ আছে। সেসব কারণে এটি ভাঙা হয়েছে। সেখান থেকে আমাদের কেউ পাঁচটি টাকাও আনেনি।’

সজীব আহমেদ নামের আরেক তরুণ বলেন, ‘এটি ভাঙার কারণ রাত ৯টা থেকে ৩টা পর্যন্ত অসামাজিক কার্যকলাপ। মদ, গাঁজাসেবন করা হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের আমল থেকে মাদক ব্যবসা চলছে। এলাকার যুবসমাজ মেনে নিতে না পারায় ভাঙচুর করেছে। অনেক দিন ধরে তাদের বললেও কাজ হয়নি। সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে ভেঙেছে। আগেও দুবার ভাঙার জন্য প্রশাসনের কাছে কাগজ পাঠানো হয়।’

ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আস্তানাটি ভাঙার পর পুলিশ জানতে পারে। এটি নিয়ে আগে কেউ পুলিশকে জানায়নি। পুলিশ গিয়ে দেখে, ঘরের টিনগুলো কাটা। কিছু বাদ্যযন্ত্র ভাঙা হয়েছে। বিভিন্ন সময় লোকজন আসত এবং গানবাজনা হতো। স্থানীয়দের অভিযোগ ছিল, গানবাজনার কারণে ধর্মীয় কার্যক্রম ব্যাহত হতো। স্থানীয় লোকজন এ ধরনের কাজ না করতে আহ্বান করেন। তারপরও চলমান থাকায় শুক্রবার নামাজের পর ভাঙা হয়। খবর পেয়ে পুলিশ গেলেও কাউকে পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ৫০–৬০ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। তাঁদের ধরতে পুলিশ তৎপর আছে।