‘তোমাদের চেতনা, অনুপ্রেরণা সব সময় আমাদের ছায়ার মতো ঘিরে আছে’

ঠাকুরগাঁওয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি খোলা চিঠি লিখে আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বিকেলে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের বড়মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

৪৫ জন শিক্ষার্থীর মতো ঠাকুরগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অবন্তি সাহাও তার লেখা চিঠিটি বেলুনে বেঁধে আকাশে উড়িয়ে দেয়। অবন্তি সে চিঠিতে লিখেছিল, ‘তোমরা নিজের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা দিয়েছ। এ ঋণ কখনো শোধ হওয়ার নয়। তোমাদের চেতনা, অনুপ্রেরণা সব সময় আমাদের ছায়ার মতো ঘিরে আছে। তোমাদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতায় দেশের একজন গর্বিত নাগরিক হয়ে নিয়ে যাব অনন্য উচ্চতায়।’

মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের উদ্দেশে এ চিঠি লেখে অবন্তি। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী শহরের সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের বড় মাঠে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি খোলাচিঠি লেখার এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৪৫ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। পরে শিক্ষার্থীরা তাদের লেখা চিঠি গ্যাস বেলুনে বেঁধে আকাশে উড়িয়ে দেয়। উড়তে উড়তে বেলুনগুলো চিঠি নিয়ে আকাশে মিলিয়ে যায়।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও জেলা পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়। পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত দিবস উপলক্ষে রোববার চিঠি লেখাসহ জেলায় নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। জেলা প্রশাসনের আয়োজনে রোববার সকাল ১০টার দিকে মুক্তি শোভাযাত্রা বের করা করা হয়। শোভাযাত্রাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে শুরু হয়ে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো চত্বরে গিয়ে শেষ হয়।

চিঠি লেখার প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীরা তাদের আশা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা লিখে জানায় বীর শহীদদের। ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শ্যামাশিস বিশ্বাস লিখেছে, ‘তোমাদের দেখানো পথে যেন, আমরা সব সময় চলতে পারি; তোমাদের মতো দেশকে ভালোবাসতে পারি—এই আশীর্বাদ করো।’

অনেকে আবার আক্ষেপের কথাও লেখে। ঠাকুরগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসিন বিনতে তারেক লেখে, ‘আপনারা যেই বাংলা চেয়েছিলেন, যেই বাংলার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন; সেই বাংলা কি আমরা পেয়েছি? সেই অসাম্প্রদায়িক, দুর্নীতি ও প্রতিহিংসামুক্ত দেশকে কি আমরা গড়তে পেরেছি? না, পারিনি।’

প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সাজ্জাদুর রহমান বলে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদেরা সবার আবেগ ও অনুপ্রেরণা। তাঁদের উদ্দেশে অনেক কথাই মনে জমা থাকে, কিন্তু কখনো বলা হয় না। আজ এই চিঠি লেখা প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে মনের সেই কথাগুলো বলতে পেরেছে তারা। যদিও এই কথাগুলো শহীদদের কাছে পৌঁছাবে না, তবু মনের আবেগ নিয়ে শহীদদের ত্যাগকে স্মরণ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

এর আগে বিকেল চারটার দিকে কর্মসূচির উদ্বোধন করেন বীর মুক্তিযুদ্ধ দবিরুল ইসলাম। এ ছাড়া আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ফারুক হোসেন, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ঠাকুরগাঁও সংসদের সভাপতি সেতারা বেগম প্রমুখ বক্তব্য দেন। পরে আবৃত্তি, গণসংগীত ও স্বাধীনতার গান পরিবেশনার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সম্মাননা দেওয়া হয়।

উদীচীর জেলা সংসদের সভাপতি সেতারা বেগম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের ত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তুলে ধরার লক্ষ্যে এই আয়োজন। প্রতিযোগীরা চিঠিতে তাদের মনের কথা তুলে ধরেছে।

জেলার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসেই পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ঠাকুরগাঁওবাসী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা ঠাকুরগাঁওয়ে ঢুকতে পারেনি। তবে তাঁরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ১৫ এপ্রিল শহরে ঢুকে পড়ে। ঠাকুরগাঁও ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের অধীন। তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার পঞ্চগড় থানা শত্রুমুক্ত হয় ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর। পঞ্চগড় থানা হাতছাড়া হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী ঘাঁটি স্থাপন করে ঠাকুরগাঁওয়ে।  

আরও পড়ুন

তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার সর্ব উত্তরের থানা ছিল তেঁতুলিয়া। ২৫০ বর্গমাইলের এই এলাকা গড়ে ওঠে বেসামরিক প্রশাসনিক মুক্তাঞ্চল হিসেবে। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের বাধার মুখে কোনো দিন সেখানে ঢুকতে পারেনি। দেশ-বিদেশের প্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের আগমনে তেঁতুলিয়া থাকত মুখর। মূল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। মিত্রবাহিনীকে রুখতে ৩০ নভেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ের ভুল্লি সেতু উড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। তারা ঠাকুরগাঁও শহরের প্রবেশপথে মাইন পেতে রাখে। মিত্রবাহিনী ভুল্লি সেতু মেরামত করে ট্যাংক ও ভারী অস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসে। তবে মাইনের কারণে শহরে ঢুকতে বিলম্ব হয়। ২ ডিসেম্বর প্রচণ্ড গোলাগুলির পর পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে। পালিয়ে যাওয়ার সময় রাতেই পাকিস্তানি বাহিনী বিজিবি ক্যাম্পের সামনে সত্যপীর সেতু উড়িয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়।

৩ ডিসেম্বর সকালে বীরের বেশে মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে শহরে প্রবেশ করেন। সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন।