বৃষ্টির আগেই হাওরের ধান কাটা প্রায় শেষ, স্বস্তি কৃষক পরিবারে

বৃষ্টি শুরুর আগেই সুনামগঞ্জের হাওরের বেশির ভাগ ধান কেটে ফেলায় কৃষক পরিবারে স্বস্তি এসেছেছবি: প্রথম আলো

ধান শুকানোর খলায় নারী, পুরুষ, শিশু—সব বয়সী মানুষ ব্যস্ত। দুপুরের তপ্ত রোদ নেই। হালকা বাতাসও আছে। কৃষক দম্পতি ইসহাক ইসলাম ও ফাতেমা বেগম শুকনা ধান বাড়িতে পাঠানোর কাজ তদারক করছিলেন। হাওর থেকে বাড়িতে ধান পাঠানো মানেই একধরনের স্বস্তি ও তৃপ্তি। তাঁদের চোখেমুখে সেটিই ফুটে উঠেছে।

এই কৃষক দম্পতির বাড়ি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরপারের ভাটি তাহিরপুর গ্রামে। গ্রামের বড় গৃহস্থ পরিবার তাঁরা।

গত শুক্রবার বিকেলে গ্রামের পাশে হাওরের খলায় কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। গত সপ্তাহে তাঁদের মধ্যে যে তাড়াহুড়া ছিল, সেটা এখন নেই। ইসহাক ইসলাম বলছিলেন, ‘কয় দিন থেকে সবাই বলেছে খুব বৃষ্টি হবে, বন্যা হবে। তাই কৃষকেরা তাড়াহুড়া করছেন। কিন্তু মে মাসের তো তিন দিন গেলগি। পরিস্থিতি এখনো ভালা। এর লাগি মন থাকি ভয়টা কাটছে।’

মে মাসের প্রথম থেকে সুনামগঞ্জে ও জেলার উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। এতে উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের আশঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের এমন পূর্বাভাসের বরাত দিয়ে কয় দিন থেকে হাওরের ধান দ্রুত কাটার নির্দেশ দেন পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তবে এখন হাওরে অকালবন্যা বা পাহাড়ি ঢল হলেও ধানের ক্ষতির আশঙ্কা কেটে গেছে বলে জানিয়েছেন কৃষক ও কর্মকর্তারা।

তাহিরপুর উপজেলার চিকসা গ্রামের বাসিন্দা কৃষক ফয়জুন্নুর মিয়া (৫৫) বলেন, তিনি হাওরে চার একর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছিলেন। দুই একরের ধান গোলায় তুলেছেন আগেই। এক এক জমির ধান কাটা বাকি ছিল। এখন এই ধান কেটে খলায় এনে রেখেছেন। শুধু শুকানোর কাজ বাকি। আর দুই দিনে সব শেষ হয়ে যাবে। একই গ্রামের কৃষক মোশাররফ মিয়া (৪৮) বলেন, ‘আমার ধান তোলা প্রায় শেষ। এখন যা আছে, ইতা বন্যা অইতে অইতে টাইন্যা তুলিলিমু।’

খলার এক পাশে বাতাসে ধান ঝেড়ে ছিটা সারাচ্ছিলেন আছিয়া বেগম (৫০)। তিনি বলেন, সেই ছোটবেলা থেকে তিনি হাওরে বৈশাখী ধান তোলেন। বাবার বাড়ি, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি—সবখানেই ধান তোলার কাজ করেছেন। কৃষক পরিবারের নারীদের এই কাজে কষ্টের চেয়ে আনন্দটাই বেশি।

কৃষক আজির উদ্দিন এবার ধানের ফলন ভালো হওয়ায় খুশি। বলেন, ১০ কিয়ার (৩০ শতাংশে ১ কিয়ার) জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। সাড়ে ছয় কিয়ার জমির ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর পর গোলায় তুলেছেন। সব মিলিয়ে ধান পেয়েছেন ১৫০ মণ।

একসময় হাওরে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ শ্রমিকেরা করতেন। এখন হারভেস্টর মেশিনে এসব কাজ করায় কৃষকদের শ্রম ও সময় কম লাগে। এ প্রসঙ্গে এলাকার প্রবীণ সাহাদত আলী (৮০) বলেন, ‘এখন কত কত ধানের জাত ধান। ফলনও বেশি অয়। মেশিনে ধান কাটে, মাড়াই করে। আমরা ধান তুলতে পুরা বৈশাখ মাস লাগত। অখন ১০ দিনে সব শেষ অইজায়। সবতা সোজা অইছে।’

জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১২টি উপজেলার ১৩৭টি ছোট–বড় হাওর ও বিলে এবার ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। হাওরের এই জমিকে দুই ভাগে ভাগ করেন তাঁরা। এক ভাগে ‘হাওর', যেটা ভেতরের অংশ। অন্য ভাগে ‘নন–হাওর’ যেটা হাওরের উঁচু অংশ। মোট আবাদকৃত জমির মধ্যে হাওরে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৩৬১ হেক্টর এবং নন–হাওরে ৫৫ হাজার ৪৬ হেক্টর আছে। হাওরে সাড়ে ৯৮ শতাংশ এবং নন–হাওরে ৬০ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। ‘নন–হাওর’ জমি তুলনামূলক উঁচু হওয়ায় এখন পাহাড়ি ঢল নামলে ক্ষতির আশঙ্কা কম।

এবার ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। উৎপাদিত এই ধানের মূল্য ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকা।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি বাড়ছে। সুনামগঞ্জে ও উজানে ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা আছে। এ কারণেই দ্রুত ধান কাটার কথা বলা হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেছেন, হাওরে ধান কাটা এখন একেবারেই শেষ পর্যায়ে। বৃষ্টি না হওয়ায় আরও ভালো হয়েছে। পর্যাপ্ত হারভেস্টর থাকায় ধান কাটা দ্রুত হয়েছে। এখন আর কোনো সমস্যা হবে না।