নামজারির ঘুষ নির্ধারণ করে দিলেন এসিল্যান্ড, ছড়িয়ে পড়েছে অডিও

পিরোজপুর জেলার মানচিত্র

পিরোজপুরের নাজিরপুরে জমির নামজারি করার জন্য ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তারা ছয় হাজার টাকা ঘুষ নেবেন বলে নির্ধারণ করে দিয়েছেন এসিল্যান্ড বা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুদুর রহমান।

গত জুলাইয়ে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে সভা করেন তিনি। ওই সভার কথোপকথনের একটি অডিও সম্প্রতি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে, যাতে ওই ঘুষ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

এ ঘটনায় গতকাল রোববার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুদুর রহমানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সঞ্জীব দাশ।

জমি বিক্রির পর পুরোনো মালিকের নাম বাদ দিয়ে নতুন মালিকের নামে জমি রেকর্ড করাকে নামজারি বলা হয়। বিক্রি ছাড়াও উত্তরাধিকার ও দান সূত্রে জমির মালিকানা পরিবর্তন হয়। এসব জমির মালিকানা পরিবর্তনের পর নতুন মালিকের নামে নামজারি করে রেকর্ড করা হয়। নামজারির জন্য সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে আবেদন করতে হয়। নামজারি বা নাম খারিজ করতে সরকার নির্ধারিত খরচ ১ হাজার ১৭০ টাকা।

তবে অভিযোগ রয়েছে নামজারির জন্য ভূমি অফিস সরকার নির্ধারিত টাকার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা নিয়ে থাকে। নামজারির পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন উপজেলা ভূমি অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত জুলাইয়ে নাজিরপুর উপজেলা ভূমি অফিসে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি সভা করেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুদুর রহমান। আলোচনার একপর্যায়ে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুদুর রহমান সিদ্ধান্ত দেন নামজারিতে ছয় হাজার টাকা করে নেওয়ার।

ওই সভায় নামজারির জন্য ঘুষ নির্ধারণের কথোপকথনের অডিও সম্প্রতি ফাঁস হয়। ওই অডিওতে শোনা যায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘এখান আমাকে পরিষ্কার করে একটি বিষয় আপনাদের অবগত করতে হবে, আমি ইউএনও স্যারের কাছ থেকে চাপে আছি। ধরেন, আমার অফিস থেকে নামজারিতে অতিরিক্ত আদায় বন্ধ করা হলো। আপনারা পার কেইস যে ডিল করেন, এটা আপনারা নিশ্চিত করবেন কীভাবে যে আপনারা টাকা নিচ্ছেন না। আপনাদের মতামত শুনি, আপনারা কী চান? কত করে নেওয়া হোক? খোলামেলা আলোচনা করেন, মতামত দেন। সবাই এখানে উপস্থিত আছেন। যদি বলেন স্যার, আপনি যদি না করে দেন, তাহলে নিশ্চিত করব আমরা কোনো টাকাপয়সার লেনদেন করব না। কিন্তু বাস্তবে এটা কখনো হবে না। আপনারা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন। কাজ করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই মানে খরচ আছে এবং বিভিন্ন ধরনের বিষয় আছে, যেটার কারণে এটা নিতে হচ্ছে বা নিচ্ছেন। এটা কমবেশি সবাই নিচ্ছে। কিন্তু এটা যে এই অফিসে দেওয়া ইইতেছে বিধায় আপনারা এটাকে বড় আকারে একটা কিছু করবেন, এই ধরনের অভিযোগ আসলে আমার জন্য বিব্রতকর।’

ওই সভায় সহকারী কমিশনার ভূমি আরও বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার সাথে শাখারীকাঠী ইউনিয়ন তহসিলদার মো. শাখাওয়াত সাহেবের সব বিষয়ে কথা হয়েছে। ধরেন, একজনের দুই একর জমি আছে, তাঁর কাছ থেকে নামজারির ক্ষেত্রে কত টাকা নেবেন? যেহেতু তাঁর জমি বেশি, তাঁর কাছ থেকে বেশি টাকা নেবেন, এ রকম।’

তখন এক ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা বলেন, ‘টাকা সবার জন্য সমান হওয়া উচিত। যেমন পাঁচ হাজার ছিল, সেখানে আপনি বললে, চার হাজার টাকায় নামিয়ে আনতে পারি। আপনি যেভাবে বলবেন স্যার।’  

এ সময় সহকারী কমিশনার (ভূমি) বলেন, ‘ধরেন, আমি চার হাজার নির্ধারণ করে দিলাম। আপনারা কত ডিল করবেন? ক্লিয়ার কথা বলেন। প্রয়োজনে কথাগুলো রেকর্ড থাকবে।’

তখন একজন ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা বলেন, ‘সর্বোচ্চ ৬-এর বেশি আমরা নেব না।’ এরপর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তারা একমত হন দলিলপ্রতি ছয় হাজার টাকা করে নেবেন।’

সহকারী কমিশনার (ভূমি) বলেন, ‘ছয় হাজার মানে ছয় হাজারই। ছয় হাজার ১০০ টাকা হলে পরবর্তী সময়ে আমি ব্যবস্থা নেব।’  

এ বিষয়ে আজ সোমবার দুপুরে মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমি সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ঢাকায় আছি। নাজিরপুরে গিয়ে এ ব্যাপারে কথা বলব। তবে আমি এখানে যোগদানের পর কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেনে জড়িত ছিলাম না।’  

ইউএনও সঞ্জীব দাশ বলেন, ‘অডিওর কথোপকথন শুনেছি। বিষয়টি খুবই বিব্রতকর। এ ব্যাপারে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুদুর রহমানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় তিন সদস্যর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।