ধবধবে সাদা ধূপ বক

রাজশাহীর পদ্মার চরে একঝাঁক ব্যস্ত ধূপ বক
ছবি: লেখক

পঞ্চগড়ের আটোয়ারী সীমান্ত ঘেঁষে হাঁটছিলাম। পাশে ক্ষীণধারায় বয়ে চলেছে নাগরা-নাগরী নদী। ওপারে ভারতের চা-বাগান। চা-বাগানের ছায়াদান করা গাছে বসে আছে একটি সাদা বক আর দুটি পাকড়া মাছরাঙা। পানিতে ওগুলোর ছায়া পড়েছে। হাঁটুপানির নদীতে কোথাও কোথাও পায়ের পাতাও ভেজে না; অথচ ছোট মাছের কমতি নেই। ছেলেমেয়েরা মাছ ধরায় মেতে উঠেছে।

কাছেপিঠে বকগুলোও ধীরেসুস্থে হেঁটে হেঁটে মাছ খুঁজে খুঁজে খাচ্ছে। কোনো তাড়া নেই কারণ, প্রচুর মাছ। তিন জায়গায় তিনটি কালো চঞ্চুর ছোট সাদা বক হেঁটে হেঁটে মাছ শিকার করছে। চমৎকার দৃশ্য। দৃশ্যটি ২০১১ সালের ৫ অক্টোবরের; কিন্তু এখনো চোখে ভাসে।

এ জীবনে যত বক দেখেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বোধ হয় এসব বকই দেখেছি। সারা দেশের যেখানে যাই, সেখানেই এসব বকের দেখা মেলে। তবে ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল রাজশাহীর পদ্মার চরে দেখা একঝাঁক ব্যস্ত বকের কথা কখনো ভুলব না। কিসের জন্য ওগুলো ব্যস্ত ছিল সেদিন?

মাছ ধরার জন্য। পানির মধ্যে জেগে থাকা এক টুকরা চরের পাড়ে দাঁড়িয়ে সহজেই মাছ শিকার করছিল। মাছ ধরতে মোটেও কষ্ট হচ্ছিল না। ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট মাছ ওগুলোর সামনে লাফালাফি করছিল আর তীক্ষ্ণ ছুরির মতো চঞ্চু চালিয়ে বকগুলো সহজেই মাছ ধরে ধরে চালান করে দিচ্ছিল পেটে। কী অপূর্ব সেই দৃশ্য!

পদ্মার নদীর চরের পাশে অল্প পানিতে একাকী ধূপ বক
ছবি: লেখক

প্রায় দেড় বছর পরের আরেকটি ঘটনা। রাজশাহীর পদ্মা নদীর ১০ নম্বর চর থেকে ২০১৯ সালের ৬ ডিসেম্বর বিকেলে নানা প্রজাতির হাঁস ও সৈকতপাখির ছবি তুলে ফিরছিলাম। এমন সময় চরের কাছে নদীর অল্প পানিতে একা একটি সাদা বককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। বকটির কথা মনে রাখার একটিই কারণ, ওটি যেভাবে এক পায়ে ভর করে অন্য পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল, তাতে সহজেই ওটির পায়ের পাতা ও তলার হলদে রং চোখে পড়েছিল। এ রকম একটি ছবি আমার খুবই দরকার ছিল।

যাহোক, সর্বশেষ এসব বক প্রচুরসংখ্যক দেখলাম গাজীপুর সদরের বেলাই বিলে, সপ্তাহখানেক আগে।

ছোট আকারের ধবধবে সাদা বকটি এ দেশের বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখি ধূপ বক। ছোট বক, সাদা বক বা ছোট কোঁরচে বক নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম লিটল ইগরেট। আরডেইডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Egretta garzetta। ভারত উপমহাদেশসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বহু দেশে এসব বকের দেখা মেলে।

ধূপ বকের দেহের দৈর্ঘ্য ৫৫ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৩৫০ থেকে ৫৫০ গ্রাম। আকারে বেশ ছোট বকটির পুরো দেহ ধবধবে সাদা। তবে পা কালো, পায়ের তলা আর আঙুল হলুদ, চঞ্চু কালচে।

প্রজনন মৌসুমে মাথার ওপর থেকে পেছন দিকে দুটি ঝুঁটির মতো পালক ঝুলে থাকে। তা ছাড়া বুক ও পিঠে কিছু সুতোপালক গজায়। চঞ্চু ও চোখের পাশের নীল-ধূসর চামড়া লালচে রং ধারণ করে। চোখের রং হয় হলুদ। মুখের সংযোগস্থল আর নিচের চঞ্চুর গোড়া হয় হলদে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। প্রজননহীন ও অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির সুতোপালক ও ঝুঁটি থাকে না। চিকন গলা, সরু কালো চঞ্চু এবং কালো পা ও হলুদ আঙুলের মাধ্যমে গো-বক থেকে সহজেই এ বককে পৃথক করা যায়।

বর্ষা অর্থাৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস এ বকের প্রজননকাল। এ সময় অন্যান্য জলচর পাখির সঙ্গে গাছের শাখায় সাধারণত উপনিবেশ বা কলোনি বাসা গড়ে তোলে। ডালপালা দিয়ে তৈরি এ বাসা দেখতে অনেকটা থালার মতো। ডিম পাড়ে তিন থেকে পাঁচটি, রং ফ্যাকাশে নীলাভ সবুজ। ডিম ফোটে ২১ থেকে ২৫ দিনে। স্ত্রী-পুরুষ দুটিই পালাক্রমে ডিমে তা দেয় ও ছানার যত্ন করে। ছানাগুলো ৪০ থেকে ৫০ দিনে উড়তে শেখে। তারপর বাসা ছেড়ে যায়। বেঁচে থাকে প্রায় ছয়-সাত বছর।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ