‘ঘরের মধ্যে বড় বড় ফাটল ধরছে, বাতাসে কাঁপে’

ঘরগুলোর পলেস্তারা খসে পড়ছে। আছে সুপেয় পানির সংকট। শৌচাগারগুলোর অবস্থা যাচ্ছেতাই। ভয় নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে বাসিন্দাদের।

দুই বছর না যেতেই ঘরগুলো বেহাল। মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার শিলই ইউনিয়নের দেওয়ানকান্দি এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পে
ছবি: প্রথম আলো

‘আগে ঘর ছিল না, মানুষের বাড়ি বাড়িতে থাকতাম। শেষ বয়সে কই থাকমু, এইডা লইয়া সব সময় চিন্তা করতাম। সরকারি পাকা ঘর পাইয়া সব চিন্তা শেষ হইছিল। আমাগো মতো ঘরহারা মানুষের খুশির সীমা ছিল না। ওই ঘরই অহন বড় দুশ্চিন্তার কারণ হইয়া দাঁড়াইছে। ঘরের মধ্যে বড় বড় ফাটল ধরছে, বাতাসে কাঁপে, দেওয়ালের বালু আগলা হইয়া পইরা যাইতাছে। গত বছর একটা ঘরের বারান্দা পইড়া গেছে। মনে অয় এবার তুফান ছাড়লে আমাগো ঘরও মাথার ওপরে ভাইঙা পড়বো।’

কথাগুলো বলছিলেন মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার শিলই ইউনিয়নের দেওয়ানকান্দি এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা কুলসুম বেগম। তিনি সেখানের ৭৮ নম্বর ঘরে থাকেন। এমন দূরবস্থা ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের অন্তত ১০ থেকে ১৫টি ঘরের। সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে ঘরগুলোর পলেস্তারা খসে পড়া, সুপেয় পানির সংকট, বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা, বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই পানি চলে আসা, রাস্তা ও শৌচাগারগুলোর দুরবস্থা।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের অংশ হিসেবে জমি ও ঘর দেওয়ার কাজ শুরু হয়। এর অংশ হিসেবে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে উপজেলার দেওয়ানকান্দি এলাকায় ৭৮টি ঘর নির্মাণ করে উপকারভোগী পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ঘরপ্রতি নির্মাণ ব্যয় হয় ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দেওয়ানকান্দি আশ্রয়ণ প্রকল্পের পূর্ব পাশের ৭৬ নম্বর ঘরের বারান্দার চাল ও পিলার গত বছরের সিত্রাং ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে অনেক ঘরে। ১৪ নম্বর ঘরের পিলার ফেটে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক ঘরের দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে।

আমাদের ঘরে যে ফাটল দেখা দিয়েছে, তাতে যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। 
শেফালি বেগম, দেওয়ানকান্দি এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা  

৪ নম্বর ঘরের বাসিন্দা শেফালি বেগম বলেন, ‘গত তুফানে পূর্ব দিকের দুটি ঘরের চাল উড়ে গেছে এবং পিলার ভেঙে পড়ে গেছে। ঝড়ের সময় আমি এবং আমার স্বামী আমাদের ঘরের চাল ধরে বসেছিলাম, যাতে চাল উড়ে না যায়। আমাদের ঘরে যে ফাটল দেখা দিয়েছে, তাতে যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে।’

আশ্রয়ণের ঘরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাসিন্দাদের কেউ ভালো নেই। সবার ঘরে কিছু না কিছু সমস্যা আছেই। তাঁদের ভাষ্য, ঘর পাকা হলেও ভয় নিয়ে বসবাস করতে হয়। অল্প টাকায় বারান্দাসহ তিন কক্ষের ঘর বানানো হয়েছে। কাজ হয়েছে একেবারে নিম্ন মানের। দেওয়া হয়নি পরিমাণ মতো সিমেন্ট, পিলারে নেই রড। ঘর হস্তান্তরের সময় রং করে চাকচিক্য দেখানো হয়েছিল। দুই বছর না হতেই এখন ঘরের দেয়াল ভেঙে যাচ্ছে।  পাঁচ বছর টিকবে কি না সন্দেহ।

৬৭ নম্বর ঘরের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, ঘরে বালুর জন্য থাকা যায় না। চিমটি দিলেও পলেস্তারা খুলে পড়ে যায়। শৌচাগার ঘরের মধ্যে বানানো হয়েছে। অথচ ওপরের অংশ খোলা। ঘরের মধ্যে সব সময় দুর্গন্ধ থাকে। দেড় ফুট উচ্চতার তিনটি চাকা দিয়ে সেপটিক ট্যাংক করা হয়েছে। প্রতি মাসেই শৌচাগার মলমূত্রে ভরে যায়। আশ্রয়ণের পূর্ব পাশের ১২টি ঘরের জন্য একটি টিউবওয়েল ছিল, সেটাও চুরি হয়ে গেছে।

অনেকেই থাকেন না আশ্রয়ণ প্রকল্পে

দেওয়ানকান্দি এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৭৮টি ঘরের মধ্যে ১ ও ৬ নম্বর ঘরসহ ৫ থেকে ৬টি ঘরের উপকারভোগীরা থাকতে আসেন মাঝেমধ্যে। ১০, ৭০, ৭২, ৭৪, ৭৫, ৭৬ ও ৭৭ সাতটি ঘরে শুরু থেকেই থাকে না বরাদ্দ পাওয়া পরিবারগুলো। এ ছাড়া ১, ৬, ১০, ৭০, ৭২, ৭৪, ৭৫, ৭৬ ও ৭৭ নম্বর ঘর তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায়।

সেখানকার বাসিন্দা মো. শাহীন জানান, ‘পূর্ব পাশের ১২টি ঘরের মধ্যে ৭টি ঘরে নির্মাণের পর থেকে কেউ থাকেন না। তাঁরা এখানে নিজেদের নামে ঘর নিলেও বসবাস করেন এলাকায় নিজ বাড়িতে। এসব ঘরের বাসিন্দা কারা, সেটাও আমরা জানি না। এমন মানুষদের ঘর না দিয়ে প্রকৃত গৃহহীন পরিবারকে ঘর দেওয়া উচিত।’

আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলোর দৈন্যদশা নিয়ে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক কাজী নজরুল বলেন, যাঁদের ঘর দেওয়া হয়েছে, দেখভাল করার দায়িত্ব তাঁদের ছিল। যেসব ঘরে ফাটল ধরেছে, পলেস্তারা খসে পড়ছে, সেগুলোর খোঁজ নেওয়া হবে। সরকারের পক্ষ থেকে যতটুকু করার আছে, সবটুকু করা হবে। এ ছাড়া যেসব উপহারের ঘরে মানুষজন থাকেন না, তাঁদের নাম বাতিল করে অন্য আশ্রয়হীন ও গৃহহীন পরিবারকে তোলা হবে। যেখানে টিউবওয়েলের ব্যবস্থা নেই, সেখানে ব্যবস্থা করা হবে।