‘আল্লাহ হামার কলিজাটাক হাতত এনে দেও’

তুরস্কে ভূমিকম্পে ছেলের অনিশ্চিত পরিণতিতে বাবা–মায়ের আহাজারি। মঙ্গলবার বিকেলে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার দেওনাই গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে আট বছর আগে উচ্চশিক্ষার জন্য তুরস্কে পাড়ি জমান বগুড়ার গাবতলী উপজেলার কাগইল ইউনিয়নের গোলাম সাঈদ ওরফে রিংকু (২৮)। ভর্তি হন তুরস্কের খাহরামানমারাস সুতচু ইমাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জিওগ্রাফি বিষয়ে। থাকতেন খাহরামানমারাস প্রদেশে। পড়াশোনা শেষে স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন। পরীক্ষাও শেষ। তিন মাস পর দেশে ফিরে বিয়ে করার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু হঠাৎ ভয়াবহ ভূমিকম্পে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেল।

সাঈদের সঙ্গে সর্বশেষ গত শনিবার হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় তাঁর ছোট ভাই গোলাম রসুলের। গতকাল সোমবার ভোর ৪টা ২৩ মিনিট পর্যন্ত তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ সক্রিয় ছিল। কিন্তু এর পর থেকে তাঁর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন

স্বজনেরা বলছেন, সাঈদ যে ভবনে থাকতেন, সেটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের কাছেই ভবনটি। ওই ভবনে থাকা আরেক বাংলাদেশি নূরে আলম বের হতে পেরেছিলেন। তিনি এখন হাসপাতালে। তবে তিনি সাঈদের কোনো খোঁজ দিতে পারেননি।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, কাগইল করুণাকান্ত উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাসের পর সাঈদ ভর্তি হন বগুড়া শহরের আর্মড পুলিশ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখান থেকে ২০১৩ সালে এইচএসসি পাসের পর ২০১৫ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি তুরস্কে যান। তাঁর বাবা গোলাম রব্বানী পেশায় একজন কৃষক। আর মা সালমা বেগম গৃহিণী। তিন ভাইবোনের মধ্যে সাঈদ মেজ।

বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, তুরস্কে দ্বিতীয় ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৫। এর কেন্দ্রস্থল ছিল খাহরামানমারাস প্রদেশের এলবিস্তান জেলায়।

আরও পড়ুন

সাঈদের ছোট ভাই গোলাম রসুল মঙ্গলবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাইয়ার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মা-বাবা তাঁর জন্য কান্নাকাটি করছেন। অজানা শঙ্কায় দিন কাটছে আমাদের। তিনি জীবিত আছেন নাকি ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়েছেন, কেউ বলতে পারছে না। বাংলাদেশের তুর্কি দূতাবাসে গিয়েও কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।’

গোলাম রসুল বলেন, ২০১৭ সালে একবার দুই মাসের জন্য দেশে ফিরেছিলেন তাঁর ভাই। ওই বছরের কোরবানির ঈদের পর আবার তুরস্কে চলে যান। এরপর নিয়মিত পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। চূড়ান্ত পরীক্ষাও শেষ হয়েছে। তিন মাস পর দেশে ফিরে তাঁর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। মা-বাবা পাত্রীও খোঁজা শুরু করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘ভাইয়াকে নিয়ে কত স্বপ্ন, হঠাৎ ভূমিকম্পে সব লন্ডভন্ড করে দিল।’

গোলাম সাঈদ ওরফে রিংকু
ছবি: সংগৃহীত

গোলাম রসুল বলেন, তুরস্কে ভূমিকম্পের খবর শোনার পরপরই গতকাল বিকেলে বাবা ভাইয়াকে ফোন দিতে বলেন। কিন্তু তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এর পর থেকে নানাভাবে ভাইয়ার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কেউ তাঁর খোঁজ দিতে পারেননি।

ছেলের অনিশ্চিত পরিণতিতে বাবা গোলাম রব্বানী ও মা সালমা বেগম আহাজারি করছেন। গোলাম রব্বানী বারবার বলছেন, ‘আল্লাহ হামার ছলডাক ভিক্ষা দেও, হামার সোনাটাক হাতত অ্যানে দেও। আল্লাহ হামার কলিজাটাক হাতত এনে দেও।’ সালমা বেগম বলেন, ‘কয়ডা দিন পর হামার সোনা মানিকের দ্যাশত ফিরবার কথা আচলো। তাক বিয়া করাবার চাচনু। হামার বুকের ধন, সোনা মানিকক তোমরা অ্যানা দেও।’

আরও পড়ুন

সাঈদের চাচা আগা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সাঈদের স্বপ্ন ছিল তুরস্ক থেকে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবেন। কিন্তু ভূমিকম্পে সেই স্বপ্ন লন্ডভন্ড হওয়ার পথে। তাঁর মতো ছেলে লাখে একজনও হয় না।

তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে গতকাল ৭ দশমিক ৮ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। তুরস্কের স্থানীয় সময় ভোররাত ৪টা ১৭ মিনিটে এই ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পটির কেন্দ্র ছিল সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুরস্কের গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে। ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন