দাদন আর ঋণের জালে যেভাবে আটকা পড়েছেন গৌর জলদাস
দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে জরাজীর্ণ একটি টিনের ঘরে বসবাস গৌর জলদাসের (৪০)। ঘরের টিনের ছাউনি জং ধরে ফুটো হয়ে গেছে। সাগরে মাছ ধরে সংসারের খরচ মেটান গৌর জলদাস। মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় এখন অনেকটা বেকার তিনি। অভাবে-অনটনে দিন কাটছে তাঁর।
গৌর জলদাসের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়নের উত্তর জেলেপাড়ায়। গত মঙ্গলবার তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি বলেন, ‘হাতে টাকা নেই। দোকানে বাকি পড়েছে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। এ ছাড়াও ১ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে দাদনের জালে আটকে আছি। বড় ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। নিয়মিত পড়াশোনার খরচও দিতে পারি না।’
সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় গৌর জলদাসের মতো অভাব-অনটনে দিন কাটছে সীতাকুণ্ডের প্রায় ৭ হাজার জেলে পরিবারের। গৌর জলদাসের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন সেখানে এলাকার প্রায় ৩০ জন জেলে উপস্থিত হন। সবাই তুলে ধরছিলেন নিজেদের দুর্দশার কথা।
গৌর জলদাস বলেন, বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেলে ইলিশের মৌসুমে নতুন-পুরোনো মিলিয়ে ২০টি জাল বসিয়ে মাছ ধরেন তিনি। নৌকা ও জাল মেরামত এবং চারজন শ্রমিকের বেতনের টাকা মৌসুমের শুরুতেই মহাজন থেকে ঋণ নিয়ে জোগাড় করতে হয়। মাছ ধরা যখন বন্ধ থাকে, তখন দাদন নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সরকারি সহযোগিতার চাল পান না তিনি।
উত্তর জেলেপাড়া গ্রামের সরদার শ্যামবন্ধু জলদাস বলেন, গ্রামের সরদার তিনি। তাই অন্যদের মতো দিনমজুরি করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনে পাইকারি ও খোলাবাজারে বিক্রি করে সংসারের খরচ সামাল দিয়ে আসছেন। সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় ব্যবসা বন্ধ। তিনি বলেন, ‘দুই মেয়ে ও এক ছেলের বাবা আমি, এই দুর্দিনে কষ্টের কথা কাউকে মুখ ফুটে বলতেও পারি না।’
সুমঙ্গল জলদাস নামের পাড়ার আরেক জেলে বলেন, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর পাঁচজনের সংসার। মাছ ধরে সংসারের খরচ চালাতে কষ্ট হচ্ছিল। তাই গত বছর অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছেলের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন মাঝেমধ্যে ওই ছেলে কাঠমিস্ত্রির জোগালির কাজ করে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সীতাকুণ্ডে সরকারি তালিকাভুক্ত জেলে পরিবার রয়েছে ৫ হাজার ৪৪০টি। এর মধ্যে সহযোগিতা পায় ৪ হাজার ৮০৫টি পরিবার। বছরে মা ইলিশ নিধন বন্ধে ২২ দিন ও জাটকা নিধন বন্ধে ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকে। এখন চলছে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা।
মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, সীতাকুণ্ডের কুমিরা খালে ইলিশ ধরার নৌকাগুলো সারবদ্ধভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে। বেড়িবাঁধ এলাকায় অন্তত ১০টি স্থানে ছেঁড়া জাল মেরামতের কাজ করছেন ২০ জেলে। নৌকা মেরামত করতে দেখা যায় পাঁচ থেকে সাতজন ব্যক্তিকে।
উপজেলার সলিমপুর, ভাটিয়ারী ও সোনাইছড়ির মদনাহাট এবং বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের জেলেপাড়াগুলো ঘুরে দেখা যায়, পাড়ার ভেতরে চায়ের দোকানে খোশগল্পে মেতে রয়েছেন জেলেরা। তাঁরা বলেন, পাড়ার অনেক যুবক জাহাজভাঙা কারখানায় দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন। তবে প্রতিদিন কাজ পাওয়া যায় না। বেশির ভাগ জেলে সাগরে মাছ ধরা, মাছ বিক্রি ছাড়া অন্য কোনো কাজ জানেন না। ফলে তাঁদের বেকার থাকতে হচ্ছে।
জেলেরা জানান, জাটকা নিধন বন্ধে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার পর তাঁরা ইলিশ ধরার জন্য সাগরে নামার অনুমতি পান। দুই মাস ইলিশ ধরার পর মা ইলিশের ডিম ছাড়ার জন্য আবার ২২ দিনের বন্ধ দেওয়া হয়। এরপর ১৫-২০ দিন মাছ ধরতে পারেন। পরে আর ইলিশ তেমন ধরা পড়ে না।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, জেলেরা যাতে বেকার না হন, তাই তাঁদের বিকল্প কর্মসংস্থানের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিছু জেলেকে বিনা মূল্যে গরু-ছাগল দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সীতাকুণ্ডের ২ হাজার ৬০০ জেলে পরিবারকে বছরে চার দফায় ৪০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়। এর বাইরে ৫ হাজার ৪৪০ পরিবারকে নিষেধাজ্ঞার সময় আরও তিন দফায় ১০৫ কেজি করে চাল সহযোগিতা করা হচ্ছে।
সহায়তার চাল আটকানোর অভিযোগ
গত মে মাসে ৪০ কেজি করে চাল পাওয়ার কথা সীতাকুণ্ডের ২ হাজার ৬০০ জেলে পরিবারের। চালের পরিমাণ ১০৪ মেট্রিক টন। তবে জেলেরা এই চাল পাননি। জেলেদের দাবি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় ও মৎস্য বিভাগ থেকে ৪০ কেজি করে চাল পাওয়ার জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে অন্তত ২০০ জেলে নিবন্ধন করেন। তবে তাঁদের চালও দেওয়া হয়নি।
মদনাহাট এলাকার জেলে সরদার সুনীল জলদাস প্রথম আলোকে বলেন, মৎস্য বিভাগ থেকে তাঁদের জানানো হয়েছে, পেনশন স্কিমে নিবন্ধন করতে দেরি করায় চাল ফেরত গেছে। এ বিষয়ে সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
জানতে চাইলে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ইউএনও কার্যালয় থেকে খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে চালের চাহিদা পাঠাতে দেরি হওয়ায় চাল দিতে সমস্যা হচ্ছে। খাদ্য কর্মকর্তা মে মাসের চাল জুনে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছেন। তা ছাড়া তাঁর দপ্তর থেকেও প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জেলেদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধন করতে বলা হয়েছে তা ঠিক। তবে এর জন্য সহযোগিতার চাল আটকানো হয়নি। উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা তাঁকে না জানিয়ে মাসিক হিসাব পাঠিয়ে দিয়েছেন, যার কারণে জটিলতা দেখা দেয়।