আসামি কারা, জানে না পুলিশ

নৌ দুর্ঘটনাপ্রতীকী ছবি

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে বাল্কহেডের ধাক্কায় পর্যটকবাহী নৌকাডুবির ঘটনায় করা মামলার চার দিন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো আসামিদের নাম–পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। জানা যায়নি বাল্কহেডটির বর্তমান অবস্থান। এ নিয়ে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারে ক্ষোভ বাড়ছে।

বাল্কহেডের সুকানি ও ইঞ্জিনচালকের বিরুদ্ধে গত শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ থানায় মামলা হয়। দ্রুত ও বেপোরোয়া গতিতে চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটানোর অভিযোগ এনে মামলাটি করেন নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া সোহেল রানার বাবা আ. আলীম।

মামলা হওয়ার আগে থেকেই বাল্কহেডের সুকানি ও ইঞ্জিনচালকের পরিচয় শনাক্ত ও আটকের চেষ্টায় রয়েছি।
মনিরুজ্জামান, ওসি, ভৈরব নৌ থানা

নিহত সোহেল রানা ভৈরব হাইওয়ে থানায় কনস্টেবল পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি স্ত্রী, দুই সন্তান ও এক ভাগনি নিয়ে পর্যটকবাহী নৌকার আরোহী হয়েছিলেন। দুর্ঘটনায় কেবল ভাগনি মারিয়া ভূইয়া অন্যদের সহযোগিতায় বেঁচে ফিরতে পেরেছেন। অন্যদের সলিলসমাধি হয়।

বাদী আ. আলীম বলেন, দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া সবার লাশ উদ্ধার করা হলো, দাফন হলো, কিন্তু সবাইকে যারা কবরে পাঠাল, তাঁদের ধরা গেল না। এমনকি তাঁদের নাম জানা গেল না। ভাবলে কষ্ট বাড়ে।

নৌ পুলিশ জানায়, মামলাটি তদন্ত করছে ভৈরব নৌ থানা–পুলিশ। তদন্তে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, বাল্কহেডটি দিয়ে বালু পরিবহন করা হতো। দুর্ঘটনার দিন বাল্কহেডটিতে বালু ছিল না। পেছন দিক থেকে এসে পর্যটকবাহী নৌকাটিকে ধাক্কা দেয়। এতে নৌকাটি উল্টে যায়। এ সময় ভৈরব ও আশুগঞ্জে লোক পারাপারের একটি নৌকা কাছাকাছি ছিল। ওই নৌকার সহযোগিতায় বেশ কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করা যায়। দুর্ঘটনার পর স্থানীয় ব্যক্তিদের নজর ছিল দুর্ঘটনাকবলিত নৌকাটির দিকে। তখন বাল্কহেডটি সবার নজর এড়ায়। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে বাল্কহেডটি আটক করা যায়নি।

দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া সবার লাশ উদ্ধার করা হলো, দাফন হলো, কিন্তু সবাইকে যারা কবরে পাঠাল, তাঁদের ধরা গেল না।
আ. আলীম, মামলার বাদী

দুর্ঘটনায় মারা যান কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার ইলেকট্রকিস ব্যবসায়ী বেলন চন্দ্র দে, তাঁর শ্যালকের স্ত্রী ও সম্বন্ধির মেয়ে। পরিবারের সাত সদস্য নিয়ে বেলন চন্দ্র দে ওই দিন নৌকার আরোহী হয়েছিলেন। চারজন জীবন নিয়ে তীরে ফিরতে পেরেছিলেন।

অভিযুক্ত সুকানি ও ইঞ্জিনচালক গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে বেলন চন্দ্র দের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও। বেলন চন্দ্র দের ভাইয়ের মেয়ে ঝুমা রানী দে বলেন, দুর্ঘটনা ঘটল পাঁচ দিন। এ সময়ে আসামিদের নামটি জানা গেল না। অবশ্যই হতাশ হওয়ার মতো ঘটনা। নাম জানার পর ধরার কাজ শুরু হবে। না জানি আসামি ধরতে কত দিন সময় লেগে যায়।

এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার কথা হয় ভৈরব নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর থেকে বাল্কহেডটির বিষয়ে আমাদের নজর রয়েছে। মামলা হওয়ার আগ থেকেই বাল্কহেডের সুকানি ও ইঞ্জিনচালকের পরিচয় শনাক্ত ও আটকের চেষ্টায় রয়েছি।’ পরে তিনি জানান, এখন পর্যন্ত দুটির একটিতেও সফলতা আসেনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পর্যটকবাহী বেশ কয়েকটি নৌকার মাঝি জানান, বাল্কহেডের সুকানি ও ইঞ্জিনচালকের নাম–পরিচয় জানা কঠিন কাজ নয়। বাল্কহেডের অবস্থান নিশ্চিত হওয়াও কঠিন নয়। কারণ, বাল্কহেডগুলোর বেশির ভাগ মালিক ভৈরব ও আশুগঞ্জের মানুষ। পেশা–সম্পর্কিত যেকোনো মানুষের কাছ থেকে তথ্যটি পাওয়া যেতে পারে।

মাঝির জবানিতে দুর্ঘটনার বর্ণনা

নৌ পুলিশ দুর্ঘটনাকবলিত পর্যটকবাহী নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। মাঝির নাম নাহিদ মিয়া। দীর্ঘদিন ধরে তিনি মেঘনায় নৌকা চালান। পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মীদের নাহিদ জানান, নৌকায় ১৮ জনের মতো যাত্রী ছিলেন। নদীতে ঘোরাঘুরিও শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভৈরব প্রান্তে ফিরছিলেন। তখন ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসে। মেঘনা নদীর সৈয়দ নজরুল ইসলাম সড়ক সেতুর ভৈরব প্রান্তের দিক থেকে ৪ নম্বর খুঁটি অতিক্রম করার সময় পেছন দিক থেকে বাল্কহেডটি সজোরে ধাক্কা দেয়। পেছনে কাছাকাছি বাল্কহেড আছে, এটি কারও নজরে আসেনি। ফলে সতর্ক হওয়ার সুযোগ ছিল না। ধাক্কায় নৌকাটি উল্টে যায়। নিজেও পানিতে ছিটকে পড়েন নাহিদ। তখন কাছাকাছি লোক পারাপারের একটি নৌকা ছিল। নৌকাটি এগিয়ে আসে। মাঝি নিজে দুজনকে উদ্ধারে সহায়তা করেন।

স্থানীয় লোকজন জানান, মেঘনা নদীতে পাশাপাশি দুটি রেল ও একটি সড়ক সেতু রয়েছে। তিনটি সেতুকে ঘিরে ভৈরব প্রান্তে প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী আগমন ঘটে। ঘাটে বেশ কয়েকটি পর্যটকবাহী নৌকা রয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্যমানুষ নৌকার মাধ্যমে মেঘনা নদীতে ঘুরে বেড়ান। বিশেষ করে শুক্রবার পর্যটকদের সংখ্যা বেড়ে যায়। গত শুক্রবার বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে একটি নৌকায় ১৮ জন আরোহী হন। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে বাল্কহেডের ধাক্কায় নৌকটিকে ডুবে নয়জন মারা যান।

নিহত ব্যক্তিরা হলেন কনস্টেবল সোহেল রানা, তাঁর স্ত্রী মৌসুমী বেগম (২৫), তাঁদের সাত বছর বয়সী মেয়ে ইভা বেগম, চার বছর বয়সী ছেলে রাইসুল ইসলাম, বেলন চন্দ্র দে (৪০), বেলন দের শ্যালকের স্ত্রী রুপা দে (২৬), সম্বন্ধির মেয়ে আরাদ্ধা (১১), নরসিংদীর বেলাব উপজেলার দড়িগাঁও গ্রামের কলেজপড়ুয়া আনিকা বেগম ও ভৈরব পৌর শহরের কমলপুর এলাকার স্বপন মিয়ার মেয়ে সুর্বণা বেগম (২০)।