নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকানোর গল্প শোনাল আদুরী

আরডিআরএস মিলনায়তনে জননী প্রকল্পের আওতায় জেলা পর্যায়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ম্যাস মিডিয়া ক্যাম্পেইনে নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকানোর গল্প বলছেন আদুরীছবি: প্রথম আলো

আদুরী আখতার তখন নবম শ্রেণির ছাত্রী। গত বছরের মার্চে হঠাৎই তার বাবা তার বিয়ের আয়োজন করেন। এতে রাজি ছিল না আদুরী। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ স্থানীয় বিভিন্নজনের কাছে অভিযোগ করে সে। প্রথমে বিষয়টি অস্বীকার করলেও একপর্যায়ে এক রাতে আদুরীকে একটি নির্জন বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তখন আদুরী মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়ে ঘটনা জানায় স্থানীয় উন্নয়নকর্মী জেসমিন আখতারকে। পরে পুলিশ ও ইউএনও গিয়ে বিয়েটি বন্ধ করে দেন।

ওই ঘটনায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে কাজি, বর, বরের বোন ও বাড়ির মালিককে তিন মাসের কারাদণ্ড দেন।

গতকাল সোমবার রংপুরের আরডিআরএস মিলনায়তনে জননী প্রকল্পের আওতায় জেলা পর্যায়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ম্যাস মিডিয়া ক্যাম্পেইনের উদ্বোধন করা হয়। এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে আদুরী এসব কথা বলে। সেভ দ্য চিলড্রেনের কারিগরি সহায়তায় মাতৃ ও নবজাতকের মৃত্যু কমাতে ‘জননী’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে আরডিআরএস বাংলাদেশ।

আদুরীর বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার পলাশবাড়িতে। তার বাবা জাহাঙ্গীর আলম ভ্যানচালক। সে রসুলপুর মাহতাবিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজে দশম শ্রেণিতে পড়ছে। আদুরী জানাল, মা–বাবাসহ পরিবার এখন তার পাশে। ১৮ বছরের আগে বিয়ে না করার পক্ষে যুক্তি তুলে আদুরী বলে, ‘আমি যদি বিয়ে করতাম, তাহলে লাইফে এগিয়ে যেতে পারতাম না। পড়াশোনা করতে পারতাম না। ওখানে আমার লাইফ শেষ হতে যেত। আমি জীবনে স্বনির্ভর হতে চাই।’

আদুরীর সাহসিকতার প্রশংসা করে তার স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবেদুল ইসলাম বলেন, পীরগঞ্জের কুমেদপুর ইউনিয়নে বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে আদুরী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, রংপুর বিভাগে বাল্যবিবাহের হার ৬৮ শতাংশ, যেখানে জাতীয় গড় ৫০ শতাংশ। গাইবান্ধা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও রংপুর জেলার কিশোরীদের মধ্যে ১৮ বছরের আগেই বিয়ের হার উল্লেখযোগ্য। গাইবান্ধায় ১৬ বছরের আগেই বিয়ের হার সবচেয়ে বেশি—৪৪ দশমিক ১ শতাংশ। বাল্যবিবাহের হার কমছে ধীরগতিতে।

পরিবার পরিকল্পনার উপপরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, ১৫-২০ বছর আগে জাতীয়ভাবে এই হার ছিল ৫৯ শতাংশ, এখনো তা মাত্র ৯ শতাংশ কমেছে। চরাঞ্চল ও প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো ৭০-৮০ শতাংশ বাল্যবিবাহ হয়।

বক্তারা বাল্যবিবাহের কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ তুলে ধরেন। সেগুলো হলো অভিভাবকের অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, মেয়েকে নিয়ে সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীন ভাবা, ঘটক দ্বারা প্রভাবিত হওয়া, স্থানীয় কমিউনিটি ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা, জন্ম ও বিবাহের নিবন্ধন এবং বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন নিয়ে সচেতনতার অভাব।

প্রতিরোধে অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত সভা, ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটিকে সক্রিয়করণ, বিয়ের নিবন্ধনপ্রক্রিয়া অনলাইন করা, কাজিদের ওপর নজরদারি, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ এবং কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য ও অধিকারবিষয়ক শিক্ষা দেওয়ার সুপারিশ করেন বক্তারা।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. রুহুল আমিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নাল আবেদীন, ইসলামি ফাউন্ডেশনের পরিচালক মোস্তফা মনসুর আলম খান, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক সেলোয়ারা বেগম, ‘জননী’ প্রকল্পের পরিচালক উজ্জ্বল কুমার রায়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, শিক্ষক, অভিভাবক, কিশোর-কিশোরী ও গণমাধ্যমকর্মীরা।

অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘জননী’ প্রকল্প ও ক্যাম্পেইনের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম উপস্থাপন করেন প্রকল্পের কারিগরি বিশেষজ্ঞ সৈয়দা জামিলা সিদ্দিকা। সঞ্চালনায় ছিলেন কমিউনিকেশন ও ডকুমেন্টেশন বিশেষজ্ঞ জাহানারা হৃদিতা।