কুমিল্লার ঐতিহ্যের স্মারক খাদি পোশাক আভিজাত্য ও মর্যাদার প্রতীক, তাই নিজেদের ঘর থেকেই খাদি কাপড়ের ব্যবহার বাড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ। আজ মঙ্গলবার দুপুরে কুমিল্লার কোটবাড়ী এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) ৬৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে খাদি নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৫৯ সালের ২৭ মে সমাজবিজ্ঞানী আখতার হামিদ খান বার্ড প্রতিষ্ঠা করেন। বার্ড স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান।
সেমিনারে তোফায়েল আহমেদ বলেন, কুমিল্লার খাদির জিআই স্বীকৃতি হলো, এখন চিন্তা করতে হবে খাদির প্রসার নিয়ে। কারণ, কাপড়ের জগতে অনেক প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে খাদির জায়গাটা কোথায় হবে, এ প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘বড় জায়গাটা হচ্ছে ঐতিহ্যের খাদি আমাদের আভিজাত্য ও মর্যাদার প্রতীক, খাদি আমাদের স্বাধীনতা ব্রিটিশ তাড়ানোর স্বনির্ভরতার প্রতীক। খাদির প্রসারে সেই বিষয়গুলোকে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। খাদির প্রসার নিজ ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। এখানে (বার্ড) যাঁরা আছেন, আপনাদের আনুষ্ঠানিক পোশাক হোক খাদি। বার্ডে কোনো অনুষ্ঠান হলে বার্ডের সব সদস্যরা খাদি কাপড় পরতে পারেন। অন্তত সপ্তাহে একদিন বা মাসে একদিন হলেও খাদি পোশাক পরা উচিত।’
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বার্ডের লালমাই মিলনায়তনে ‘খাদি ও কুমিল্লা: জিআই গৌরবের পথে বার্ডের পথচলা’ শিরোনামে শীর্ষক এই সেমিনার হয়। এতে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি সোহরাব হাসান।
খাদি কাপড়কে বলা হয়ে থাকে কুমিল্লার ঐতিহ্যের স্মারক। এ বছরের ৩০ এপ্রিল শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যের খাদি পেয়েছে জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ বলেন, খাদি ঐতিহ্যের পাশাপাশি দেশপ্রেমের প্রতীক। তাই খাদি পণ্যের বহুমাত্রিক ব্যবহার বাড়াতে হবে। দেশ ভাগের পর আখতার হামিদ খান বহুমাত্রিক উদ্যোগের মাধ্যমে সংকটে পড়া খাদি কাপড়ে প্রসার ঘটান। বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খানের জীবন ছিল বহুমাত্রিক প্রতিভায় ভরা। তাঁর মতো দক্ষ প্রশাসক আজও জন্ম হয়নি। আখতার হামিদ খান কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, তাঁর শিক্ষকজীবনও অনন্য। তিনি শিক্ষক থাকাকালীন সময়ে ছাত্রদের নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন করেছেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন করেছেন। তিনি ছিলেন পরশপাথরের মতো, যেখানেই গেছেন, সেটাই সোনা হয়ে গেছে। আখতার হামিদ খানের জীবন নিয়ে গবেষণা বাড়াতে হবে। তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী প্রকাশের জন্য বার্ডকে উদ্যোগ নিতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সোহরাব হাসান বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খানের কর্মজীবনের নানা দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আখতার হামিদ ছিলেন একজন মহান মানুষ। তাঁর জন্ম ভারতে, মৃত্যু পাকিস্তানে। তবে তাঁর কর্মজীবনের সবচেয়ে সাফল্যময় অংশ কেটেছে বাংলাদেশে। এ দেশের রাজনীতিতে হানাহানি, ভাগাভাগি হয়, কিন্তু এই মানুষটিকে ভাগ করা যাবে না। আখতার হামিদ খানের ছিল নিষ্ঠা, আগ্রহ, মানবপ্রেম ও মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা। তাই তো তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন মানুষের কল্যাণের জন্য। তিনি ভিন্নভাষী ছিলেন, বাংলা ভাষা শিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে পড়ার জন্য। আখতার হামিদ খানের একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে বার্ড। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন করেছেন, সেটি যেমন বিশ্ব দরবারে পরিচিত। আখতার হামিদ খানের বার্ডও কিন্তু বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ এবং কুমিল্লাকে পরিচয় করিয়েছে।
খাদি ও আখতার হামিদের প্রতিষ্ঠিত বার্ড প্রসঙ্গে সোহরাব হাসান বলেন, খাদি জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে, এটা আনন্দের। কুমিল্লার খাদি বাংলাদেশে ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে, চাহিদা বেড়েছে। আখতার হামিদ খান সংকটের সময় হাল ধরার কারণেই এই অবস্থায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। কুমিল্লা বার্ডে কর্মরত সবার নিষ্ঠার কারণে বার্ড আজও তাঁর সুনাম ধরে রেখেছে। আখতার হামিদ খানের একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনী প্রকাশ জরুরি।
বার্ডের মহাপরিচালক সাইফ উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সাবেক সচিব ও বিআরডিবির সাবেক মহাপরিচালক হুমায়ুন খালেদ এবং সম্প্রীতি কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী এমদাদ হোসেন (মালেক)। সেমিনারের আলোচক ছিলেন কুমিল্লার প্রবীণ খাদি ব্যবসায়ী ‘খাদি ঘর’–এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার রাহা। স্বাগত বক্তব্য দেন কর্মশালা পরিচালক ও বার্ডের পরিচালক (প্রকল্প) রঞ্জন কুমার গুহ এবং খাদি নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বার্ডের পরিচালক (পল্লী শিক্ষা) শেখ মাসুদুর রহমান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বার্ডের সহকারী পরিচালক আমিনুল ইসলাম।