‘পোলারে মিথ্যা বুঝ দেই, তোমার বাপে চাকরিতে গেছে, আইব’

গাজীপুরের শ্রীপুরের বাঁশবাড়ি গ্রামে ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছেন আব্দুল্লাহ। বাড়ির উঠানে বিলাপ করছেন তাঁর মা রওশন আরা। রোববার দুপুরে তোলা ছবিছবি: প্রথম আলো

দুই বছর বয়সী সন্তানকে কোল থেকে নামিয়ে গতকাল শনিবার বাড়ির বাইরে বের হয়েছিলেন মো. আবদুল্লাহ (২৬)। এরপর আর ফেরেননি। খুন হয়েছেন। কিন্তু তাঁর একমাত্র শিশুসন্তান মাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে বাবার কথা। সন্তানকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন মা।

গতকাল সন্ধ্যা সাতটার দিকে গাজীপুরের শ্রীপুরের বাঁশবাড়ি গ্রামে ছুরিকাঘাতে খুন হন মো. আবদুল্লাহ। পোশাককর্মী আবদুল্লাহ ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার টিএম বিডি লিমিটেড নামে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। আবদুল্লাহ ওই গ্রামের শাহাদাত হোসেনের ছেলে। তাঁর স্ত্রী বিউটি আক্তার। এই দম্পতির দুই বছর বয়সী একমাত্র সন্তানের নাম মো. আলিফ।

আরও পড়ুন

আজ রোববার দুপুর ১২টার দিকে আবদুল্লাহর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনদের ভিড়। বাড়ির উঠানে চিৎকার করে কাঁদছেন আবদুল্লাহর মা রওশন আরা। স্বজনেরা তাঁর চারপাশে বসে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ঘরের ভেতরে বিছানায় কাঁদছেন আবদুল্লাহর স্ত্রী বিউটি আক্তার। ছেলে আলিফকে কোলে নিয়ে ঘুরছেন এক স্বজন।
ছুরিকাঘাতে খুন হওয়া আবদুল্লাহর স্ত্রী বিউটি আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার পোলা জিজ্ঞেস করে, আব্বু কই। আমি পোলারে মিথ্যা বুঝ দেই, তোমার বাপে চাকরিতে গেছে, আইব। ছেলে তো মনে হয় ভাবতাছে, তার বাপ আসলেই আইব। কিন্তু হে তো আর আইব না কোনো দিন। হেরে তো মাইরা ফালাইছে।’

কাঁদতে কাঁদতে স্বামী হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাইছিলেন বিউটি আক্তার। তিনি বলেন, ‘এই দেশে যদি প্রশাসন থাইক্কা থাহে, তাইলে আমার স্বামী খুনের বিচার যেন তারা করে। আমি খুনির ফাঁসি চাই।’

ছেলের শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন মা রওশন আরা। স্বজনেরা তাঁকে মাথায় পানি ঢেলে সেবা–শুশ্রূষা করে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। রওশন আরা বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আমার একমাত্র পোলারে মাইরা ফালাইছে। আমার আর কী থাকল। আমারে তোমরা মাইরা থুইয়া যাও। আমার এই সর্বনাশ কেমনে করল।’

আবদুল্লাহকে খুনের অভিযোগ উঠেছে তাঁর প্রতিবেশী শহিদুল ইসলামের (শহীদ) বিরুদ্ধে। তিনি ওই এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে। ছুরিকাঘাতে হত্যার পরপরই পালিয়ে গেছেন শহিদুল। তাঁর বাড়িতে গিয়ে কাউকেই পাওয়া যায়নি।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মো. ইয়ার উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, অভিযুক্ত শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ মাদক সেবন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। তিনি শাস্তিও পেয়েছেন। ডাকাতির মতো অপরাধের সঙ্গেও তাঁর সম্পৃক্ততার নজির আছে। এ ঘটনার তদন্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান ইউপি সদস্য।

আব্দুল্লার শোকে কাঁদছেন স্ত্রী বিউটি আক্তার। তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা স্বজনদের। রোববার দুপুরে তোলা ছবি
ছবি: প্রথম আলো

আবদুল্লাহর বড় বোন আকলিমা খাতুন অভিযোগ করেন, শহীদ দীর্ঘদিন ধরে নেশাজাতীয় দ্রব্য বিক্রির সঙ্গে জড়িত। একসময় ডাকাতি করতেন। কয়েকবার কারাগারে গেছেন। তাঁর বাবার সঙ্গে শহীদের জমিসংক্রান্ত বিরোধ ছিল।

পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় আবদুল্লাহ, তাঁর মা ও বাবা শ্রীপুরের নয়নপুর এলাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। কিন্তু তিন বছর ধরে আবদুল্লাহর আয় দিয়েই চলে মা–বাবা, স্ত্রী, সন্তান ও বড় বোনের সংসার। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে পুরো পরিবার বিপাকে পড়ে গেছে। তাদের বসতভিটা ছাড়া আর কোনো সহায়সম্বল নেই।

আবদুল্লাহদের বাড়িতে যাওয়ার আগে ছুরিকাঘাতের ঘটনাস্থল বাঁশবাড়ি বাজারে কথা হয় চায়ের দোকানি আবদুস সালামের সঙ্গে। গতকাল শহীদ ও আবদুল্লাহর মধ্যে প্রথম দফা এই দোকানেই বাগ্‌বিতণ্ডা হয়েছিল।

আবদুস সালাম বলেন, আবদুল্লাহ তাঁর দোকানের বেঞ্চে বসে ছিলেন। হঠাৎ শহীদ এসে আবদুল্লাহকে বাজার ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শহীদ এগিয়ে গিয়ে আবদুল্লাহর ওপর চড়াও হন। তাঁদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। পরে আশপাশের লোকজন দুজনকে থামিয়ে বাড়িতে চলে যেতে বলেন। এর আধা ঘণ্টা পর আবদুল্লাহকে বাজারের পাশে রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।

অনেকটা একই রকমের বর্ণনা দেন বাজারের শফিকুল ইসলাম। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, শহীদ একটি ছুরি হাতে নিয়ে ভরা মজলিশ থেকে আবদুল্লাহকে জোর করে তুলে নেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাজারের পাশে অন্ধকার স্থানে রক্তাক্ত অবস্থায় আবদুল্লাহকে পড়ে থাকতে দেখেন বাজারের লোকজন। পরে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

এ ঘটনায় একটি অভিযোগ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহ জামান। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ধরতে ঘটনার পর থেকেই পুলিশ তৎপর আছে বলে তাঁর দাবি।