হাতপাখার ফ্রেমেই ঘুরছে বাক্‌প্রতিবন্ধী জামালের ভাগ্যের চাকা

সড়কের পাশে বসে বাঁশের কাঠি দিয়ে হাতপাখার ফ্রেম তৈরি করছেন বাক্‌প্রতিবন্ধী জামাল উদ্দিন। সম্প্রতি দিনাজপুরের বিরামপুর পৌরসভার ভবানীপুর মুন্সিপাড়ায় বিরামপুর-কাটলা সড়কেছবি: প্রথম আলো

ব্যস্ত পাকা সড়কের পাশে প্লাস্টিকের খালি বস্তায় বসে আছেন জামাল উদ্দিন (৫৬)। তাঁর এক হাতে বাঁশের কাঠির বৃত্তাকার চাকতি, আরেক হাতে কড সুতা। চাকতির সঙ্গে লম্বা দণ্ডকে সুতা দিয়ে শক্ত করে বাঁধছেন। সুতায় গিঁট দিতে হাত, কখনো পা, আবার কখনো দাঁতের সাহায্য নিচ্ছেন। এভাবে তাঁর হাতে তৈরি হচ্ছে হাতপাখার ফ্রেম। গ্রামে গ্রামে ঘুরে এসব ফ্রেম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি।

হাতপাখার এসব ফ্রেমের ক্রেতা মূলত গ্রামের গৃহবধূরা। তাঁরা ফ্রেমে রঙিন কাপড় মুড়িয়ে তাতে রঙিন সুতার নকশি তোলেন। ফ্রেম বিক্রির টাকায় কোনোমতে জীবন চালান জামাল উদ্দিন। এভাবেই প্রায় দুই যুগ ধরে হাতপাখার ফ্রেমেই ঘুরপাক খাচ্ছে বাক্‌প্রতিবন্ধী জামালের ভাগ্যের চাকা। তাঁর বাড়ি দিনাজপুরের বিরামপুর পৌরসভার ভবানীপুর গ্রামের মুন্সিপাড়ায়। তাঁর বাবার নাম মৃত আবদুল মান্নান।

হাতপাখার ফ্রেম তৈরি করছেন জামাল উদ্দিন। সম্প্রতি দিনাজপুরের বিরামপুর পৌরসভার ভবানীপুর মুন্সিপাড়ায় বিরামপুর-কাটলা সড়কে
ছবি: প্রথম আলো

স্টেইনলেস স্টিলের পাইপের হাতলবিশিষ্ট জামালের প্রতিটি বড় হাতপাখার ফ্রেম ৫০ টাকা এবং বাঁশের চুঙির হাতলবিশিষ্ট ফ্রেম ৩০ থেকে ৪০ টাকা। ভবানীপুর মুন্সিপাড়ার গৃহবধূ জেবুন্নাহার বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি জামাল চাচার কাছ থেকে বাঁশের চুঙিওয়ালা দুটি পাখার ফ্রেম ৩০ টাকা করে কিনেছি। একটি নিজের জন্য, আরেকটি আমাদের ছেলের জন্য। দুটি পাখাতে আমি নতুন কাপড় লাগিয়ে তাতে নকশা তুলেছি। জামাল চাচার হাতে বানানো পাখার ফ্রেমগুলো অনেক মজবুত।’

মা–বাবার অভাবের সংসারে থেকে অন্য সাত ভাই আর্থিক দৈন্য কাটিয়ে উঠতে পারলেও বাক্‌প্রতিবন্ধী জামাল উদ্দিন পারেননি। টানাপোড়েনের সংসার দেখে প্রায় দুই যুগ আগে জামাল উদ্দিনকে ছেড়ে তাঁর স্ত্রী দুই ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে যান।
বাবার রেখে যাওয়া ভাগের প্রায় ৩ শতাংশ জমি নদীর পাড়ে থাকলেও সেখানে মাথা গোঁজার জন্য বাড়ি করার সামর্থ্য হয়নি জামালের। নদীভাঙন থেকে বাঁচতে সচ্ছল ভাইয়েরা নদী থেকে নিরাপদ দূরত্বে এসে নতুন করে বাড়ি করেছেন। জামাল ঠাঁই নিয়েছেন বড় ভাই মোজাম্মেল হকের বাড়িতে।

আরও পড়ুন
দাঁত দিয়ে চেপে ধরে হাতপাখার ফ্রেম শক্ত করে বাঁধার কাজ করেছেন জামাল
ছবি: প্রথম আলো

জামাল উদ্দিনের বড় ভাই মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘জামাল উদ্দিনকে ছেড়ে তাঁর স্ত্রী-সন্তান চলে গেলেও বড় ভাই হিসেবে তো আপন ছোট ভাইকে ফেলে দিতে পারি না। সে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে হাতপাখার ফ্রেম বিক্রি করে। যখন সে এলাকায় থাকে, তখন আমার বাড়িতেই থাকে। জামাল উদ্দিনের জন্য প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করে দিতে পৌর মেয়র ও উপজেলায় কয়েকবার যোগাযোগ করেছি। কাজ হবে কি না, জানি না।’

এ বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আবদুল আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, জামাল উদ্দিন একজন বাক্‌প্রতিবন্ধী হয়েও জীবিকার জন্য কারও কাছে হাত পাতেননি। তিনি পরিশ্রম করে নিজেই উপার্জন করছেন। এটি নিঃসন্দেহে এলাকার বেকার ও প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক অনুপ্রেরণার। জামাল উদ্দিনের পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর জন্য প্রতিবন্ধী ভাতা পেতে অনলাইনে আবেদন করা হয়েছে। এটি যাচাই-বাছাই শেষে তাঁর জন্য ভাতা কার্ডের ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া সরকার থেকে বরাদ্দ করা কোনো সুযোগ-সুবিধা এলে তাঁর জন্য যতটুকু প্রযোজ্য হবে, ভবিষ্যতে সেই ব্যবস্থাও করে দেওয়া হবে।

হাতপাখার ফ্রেম বানাচ্ছেন জামাল
ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাক্‌প্রতিবন্ধী জামাল উদ্দিনের হাতে তৈরি হাতপাখার ফ্রেমের ব্যবসায় যোগ হতে পারে নতুন মাত্রা। সেই সঙ্গে তিনি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হলে স্ত্রী-সন্তানেরা তাঁর কাছে ফিরে আসতে পারেন। ফিরে পেতে পারেন সাংসারিক জীবন।

আরও পড়ুন