ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েও দুশ্চিতায় জয়
মেডিকেল কলেজের (এমবিবিএস) ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন জয় কর্মকার (১৯); সুযোগ পেয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। তবে এ লক্ষ্য পর্যন্ত পৌঁছানোর লড়াইটা তাঁর জন্য মোটেও সহজ ছিল না। কখনো টিউশনি, কখনো দোকানদারি, আবার কখনো সবজির খেতে কাজ করে তিনি লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন।
তবে এবার জয়ের সামনে মেডিকেলে ভর্তির টাকা জোগাড় করার চ্যালেঞ্জ। এর চেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো নিয়মিতভাবে সেখানে পড়াশোনার যাবতীয় খরচ জোগানো। এসব নিয়ে পরিবারটির দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
জয়ের সপরিবার বসবাস সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন হরিনগর গ্রামে। তাঁর বাবা অশোক কর্মকার স্থানীয় একটি কর্মকারের দোকানে দৈনিক চুক্তিতে দিনমজুরের কাজ করেন। মা সুচিত্রা কর্মকার একজন গৃহিণী। বাড়ির সামান্য জমিতে সবজির চাষের পাশাপাশি কখনো কখনো স্থানীয়ভাবে মেয়েদের জামাকাপড় তৈরির কাজ করেন তিনি। তিন ভাইবোনের মধ্যে জয় ছোট। বড় বোন আঁখি কর্মকার সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন; তাঁর বিয়ে হয়ে গেছে। মেজ বোন রাখি কর্মকার কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়েন।
সাতক্ষীরা শহর থেকে শ্যামনগর হয়ে ৭০ কিলোমিটার দূরে হরিনগর গ্রাম। সেখানে জয়ের বাড়িতে গতকাল সোমবার যান এই প্রতিবেদক। সাড়ে তিন কাঠা জমির ওপর দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি বাড়িতে তাঁদের বসবাস। টিনের ছাউনির ঘরটির একটি কক্ষের মেঝে পাকা ও অন্যটি কাঁচা। বাড়িটি জরাজীর্ণ। ওই পরিবারের নলকূপ নেই। প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সরকারি খাদ্যগুদামের একটি নলকূপ থেকে প্রতিদিন খাবার পানি আনেন জয়ের মা। ঘরে বসার কয়েকটি পুরোনো প্লাস্টিকের চেয়ার।
স্বজনদের সহযোগিতায় পড়েছেন খুলনার এমএম সরকারি সিটি কলেজে। সেখান থেকে ২০২৪ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। চলতি বছর মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় ৮৬ দশমিক ২৫ নম্বর নিয়ে মেধাতালিকায় তাঁর অবস্থান ১১৮তম। ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
জয় কর্মকার ২০২২ সালে স্থানীয় বনশ্রী শিক্ষা নিকেতনের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। স্বজনদের সহযোগিতায় পড়েছেন খুলনার এমএম সরকারি সিটি কলেজে। সেখান থেকে ২০২৪ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। চলতি বছর মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় ৮৬ দশমিক ২৫ নম্বর নিয়ে মেধাতালিকায় তাঁর অবস্থান ১১৮তম। ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
কথায় কথায় জয় জানান, সপ্তম শ্রেণি থেকেই তিনি প্রাইভেট পড়িয়েছেন। করোনার সময় তখন প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ থাকায় বাড়িতে একটি ছোট মুদিদোকান দেন। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা বাকিতে জিনিসপত্র নেওয়ায় সেটি আর চালাতে পারেননি। মায়ের সঙ্গে সবজির খেতে জল দেওয়াসহ অন্যান্য কাজ করেছেন।
জয়ের সঙ্গে যে কেউ কথা বললে মুগ্ধ হবেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি লেখাপড়া করে নিজেকে শাণিত করেছেন। সহযোগিতা পেলে জয় শুধু ভালো চিকিৎসকই নয়, একজন মানবিক মানুষও হবেন।আবদুল করিম, শিক্ষক, হরিনগর বনশ্রী বিদ্যা নিকেতন
জয়ের মা সুচিত্রা কর্মকার জানান, তাঁদের মোট পাঁচ বিঘা জমি আছে। লবণজলের এ এলাকায় অন্য কোনো ফসল হয় না। চিংড়িচাষিদের কাছে সে জমি ইজারা দিয়েছেন বার্ষিক ৬০ হাজার টাকায়। ওই টাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চলে। ছেলেকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির জন্য জমি ইজারা দেওয়া চিংড়িচাষির কাছ থেকে আগাম ২৪ হাজার টাকা নিয়েছেন। তাঁর স্বামী অসুস্থ; কঠিন কাজ করতে পারেন না।
জয় কর্মকার বলেন, মা-বাবার চেষ্টা না থাকলে তাঁর পড়ালেখা হতো না। তিনি চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করতে চান; গরিবের চিকিৎসক হতে চান।
একই রকম প্রত্যাশার কথা জানান হরিনগর বনশ্রী বিদ্যা নিকেতনের প্রধান শিক্ষক আবদুল করিম। তিনি বলেন, জয়ের সঙ্গে যে কেউ কথা বললে মুগ্ধ হবেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি লেখাপড়া করে নিজেকে শাণিত করেছেন। তাঁর বিশ্বাস, সহযোগিতা পেলে জয় শুধু ভালো চিকিৎসকই নয়, একজন মানবিক মানুষও হবেন।