অপহরণের পর হত্যা করে মুক্তিপণ আদায়, লাশ মিলল সেপটিক ট্যাংকে

নিহত মাদ্রাসাছাত্র তাওহীদ ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

‘আসসালামু আলাইকুম। আপনার ছেলে ভালো আছে। কেরানীগঞ্জেই আছে। আজকের মধ্যে তিন লাখ টাকা দিলে ছেলে পাবেন। বিষয়টি পুলিশ ও এলাকার কাউকে জানাবেন না। জানালে আপনার ছেলের ক্ষতি হবে।’ ঢাকার কেরানীগঞ্জে মাদ্রাসা থেকে বাসায় ফেরার পথে এক ছাত্রকে অপহরণের পর মুঠোফোনে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি এমন কথা বলেন বলে জানান ওই ছাত্রের মা।

একপর্যায়ে অপহৃত ছাত্রের মা মুক্তিপণের তিন লাখ টাকা দিলেও ছেলেকে আর জীবিত ফেরত পাননি। অপহরণের দুই দিন পর আজ সোমবার সকালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়নের আবদুল্লাহপুর এলাকায় ওই ছাত্রেরই বাড়ির পাশে একটি সেপটিক ট্যাংক থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে র‍্যাবের একটি দল।

নিহত মাদ্রাসাছাত্রের নাম তাওহীদ ইসলাম (১০)। সে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুর এলাকার রসুলপুর জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার নাজেরা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। সে ওই এলাকার সৌদিপ্রবাসী উজ্জ্বল হোসেনের ছেলে। এ ঘটনায় মুক্তিপণের টাকা আদায়ের মূল পরিকল্পনাকারী ও হত্যাকারী রাজমিস্ত্রি মকবুল হোসেনকে (৪২) গ্রেপ্তার করেন র‍্যাব-১০–এর সদস্যরা।

নিহত তাওহীদের মা তাসলিমা বেগম জানান, গত শনিবার সকালে ছেলে তাওহীদ মাদ্রাসার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়। ক্লাস শেষে অনেক দেরি হলেও বাড়ি ফিরছিল না সে। পরে বিভিন্ন এলাকায় খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। ওই দিন রাতেই অপহরণকারী মুঠোফোনে কল করে মুক্তপণ চান।

মাদ্রাসাছাত্র তাওহীদ ইসলামকে অপহরণের হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার মকবুল হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

তাসলিমা বলেন, ‘অপহরণকারীদের কথামতো দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে পদচারী–সেতুর নিচে পিলারের গোড়ায় তিন লাখ টাকা রেখে আসি। এ ঘটনায় আমি থানায় মামলা করি। মুক্তিপণ নিয়েও আমার ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমার বুক খালি করেছে। আমার বুকের মানিককে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। আমি ছেলের হত্যাকারীর ফাঁসি চাই।’

এ বিষয়ে আজ দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিষয়টি জানার পর র‍্যাব তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মকবুল হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে রাজধানীর পোস্তগোলা এলাকায় একটি হোটেল থেকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাঁর কাছ থেকে মুক্তিপণের তিন লাখ টাকার মধ্যে ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। তবে তাওহীদ ইসলামকে জীবিত উদ্ধার করা যায়নি।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তারের পর তাওহীদের অবস্থান জানতে মকবুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে মকবুল জানান, গত শনিবার তাওহীদকে অপহরণের পর তার মায়ের কাছে যখন মুক্তিপণ দাবি করা হয়, কিন্তু এর আগেই তাওহীদকে হত্যা করে লাশ আবদুল্লাহপুর এলাকায় তাওহীদের বাড়ির পাশে একটি ডোবার সেপটিক ট্যাংকে ফেলে রাখা হয়েছিল। হত্যার পর মকবুল নাটক করে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গ্রেপ্তার মকবুল পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। তিনি কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। আনুমানিক সাত থেকে আট মাস আগে মকবুল নিহত তাওহীদের বাড়ির ভবনের রাজমিস্ত্রির কাজ করেছিলেন। মকবুল ওই বাড়ির পাশে বসবাস করতেন। এ সুবাদে তিনি বুঝতে পারেন তাওহীদের পরিবার আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী। অপহরণের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা সম্ভব। তখন থেকেই তিনি পরিকল্পনা করেন।

গ্রেপ্তার মকবুলকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে অপহরণের ঘটনার বর্ণনা দেন র‍্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, গত শনিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে তাওহীদ মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষে বাসায় ফিরছিল। পথিমধ্যে মকবুল তার মুখ চেপে ধরেন। পরে কলাগাছের সঙ্গে তাওহীদের হাত-পা ও মুখ বেঁধে ফেলেন।

একপর্যায়ে সেখানে লোকজন আসার উপস্থিতি টের পেয়ে তাওহীদকে অন্যত্র সরানোর জন্য প্রাথমিকভাবে তাওহীদের মুখের বাঁধন খুলে দেন মকবুল। তখন তাওহীদ চিৎকার দিলে মকবুল তার সঙ্গে থাকা গামছা দিয়ে তাওহীদের গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। পরে লাশটি ওই এলাকার একটি ডোবার সেপটিক ট্যাংকে ফেলে রাখেন। পরে মুক্তিপণের টাকা আদায় করে আত্মগোপনে চলে যান।