বরিশাল জেলার ম্যাপ

দেশে কারিগরি শিক্ষা প্রসারে প্রথম যে ১৬টি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, এর একটি বরিশালে অবস্থিত। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির এখন পদে পদে দৈন্যদশা। এ অবস্থা চলছে যুগ যুগ ধরে। বিভিন্ন সংকটে পুরো প্রতিষ্ঠানটি এখন ধুঁকছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা আক্ষেপ করে বলেন, দেশের সর্ববৃহৎ ও পুরোনো বরিশাল সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটটির দৈন্যদশা দেখলে সহজেই বোঝা যায়, দেশের কারিগরি শিক্ষা এখনো কতটা অবহেলিত। কারণ, এখানে না আছে প্রয়োজনীয় শিক্ষক, না আছে শিক্ষার্থীদের আবাসন-একাডেমিক অবকাঠামো, না আছে পরিবহন–সুবিধা। প্রায় ৭০ বছরের পুরোনো এই প্রতিষ্ঠানটি এখন সীমাহীন সংকটের মধ্য দিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। ফলে মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী।

পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, ১৯৬২ সালে তৎকালীন সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জেলা সদরগুলোতে ১৬টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন করে। দুটি বিভাগ ‘সিভিল’ ও ‘পাওয়ার’ টেকনোলজি নিয়ে বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরে মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিকস, কম্পিউটার, ইলেকট্রোমেডিকেল এবং ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ চালু হয় হয় এই প্রতিষ্ঠানে। চার বছর মেয়াদি পড়াশোনায় আটটি বিভাগে প্রতিবছর ১ হাজার ৬০০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিতে সারা বছর চারটি ব্যাচে ৬ হাজার ৮০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন।

ইনস্টিটিউট প্রশাসন সূত্র জানায়, বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও প্রশিক্ষকের পদ রয়েছে ২৪৪টি। কিন্তু এর বিপরীতে কর্মরতমাত্র ৫৫ জন। ১৮৯টি পদই শূন্য। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলছে। এর মধ্যে সিভিল টেকনোলজিতে ২৯টি পদের স্থলে কর্মরত আছেন মাত্র ৩ জন। পাওয়ার টেকনোলোজিতে ২৪টি পদের স্থলে আছেন মাত্র ৪ জন, মেকানিক্যাল টেকনোলোজিতে ২৫টি পদের স্থলে আছেন ৩ জন, ইলেকট্রনিকস টেকনোলোজিতে ২৪টি পদের স্থলে আছেন ৩ জন, কম্পিউটার টেকনোলজি বিভাগে ২৫টি পদের স্থলে আছেন মাত্র ১ জন, ইলেকট্রোমেডিকেলে ২৩টি পদের জনের স্থলে আছেন মাত্র ১ জন। আর ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টে ১৪টি পদ থাকলেও কোনো শিক্ষক নেই।

প্রশাসন সূত্র আরও জানায়, আগে এই আটটি বিভাগে এই ইনস্টিটিউটে শিক্ষার্থী আসন ছিল ৯০০ জন। কিন্তু ২০১৬ সালে তা বাড়িয়ে ১ হাজার ৬০০ করা হয়। আসনসংখ্যা বাড়ানো হলেও সে অনুযায়ী একাডেমিক সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি। বিদ্যমান তিন ও চারতলা দুটি একাডেমিক ভবনেই নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলছে।

প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকেরা জানান, আসনসংখ্যা বৃদ্ধির পর দুই পালায় পাঠদান চালু করা হয়। বিদ্যমান শিক্ষক কাঠামোয় এই ব্যবস্থা চালু করার পর অতিরিক্ত পাঠদানের জন্য শিক্ষকেরা মূল বেতনের ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত ভাতা পেতেন। কিন্তু গত সাড়ে তিন বছর ধরে তা–ও বন্ধ।

এই প্রতিষ্ঠানে ছেলেদের একটি ও মেয়েদের একটি ছাত্রাবাস থাকলেও ছেলেদের ছাত্রাবাসটির জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় মাস দুয়েক আগে সেটি বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ১৯৭০ সালে নির্মিত ১২০ আসনের মুক্তিযোদ্ধা ছাত্রাবাসটিতে বন্ধ হওয়ার আগে ২০০ আবাসিক শিক্ষার্থী থাকতেন।

সরেজমিন

৯ মার্চ সরেজমিন দেখা যায়, তিনতলা ছাত্রাবাসটির ছাদ, দেয়াল ও মেঝে জরাজীর্ণ হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এমন জরাজীর্ণ অবস্থার কারণে এখানে বসবাসরত শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে একে একে ছাত্রাবাস ত্যাগ করেন। পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ গত ডিসেম্বরে ছাত্রাবাসটি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয়। এখন কেবল ৭৩ আসনসংখ্যার ছাত্রীনিবাসটি চালু আছে।

এই ইনস্টিটিউটের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাব্বির হোসেনের বাড়ি ‍পিরোজপুরে। সাব্বির জানান, তিনি বরিশাল নগরের কালুশাহ সড়কের একটি মেসে থাকেন। প্রতি মাসে মেসভাড়া ও খাওয়া বাবদ ৭ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। তাঁর বাবা চায়ের দোকানদার। দুই ভাইয়ের পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করা পরিবারের জন্য দুরূহ। ছাত্রাবাসে থাকার ব্যবস্থা করতে পারলে মাসে তিন হাজার টাকায় চলে যেত। এ ছাড়া কলেজে শিক্ষার্থীদের আসা-যাওয়ার জন্য কোনো পরিবহনব্যবস্থা না থাকায় এতেও বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

১২ দশমিক ৫ একর জমির ওপর স্থাপিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক জমি ফাঁকা পড়ে আছে। এরপরও অবকাঠামো নির্মাণে কোনো বরাদ্দ নেই। ২৮টি অত্যাধুনিক ল্যাব থাকলেও দক্ষ শিক্ষকের অভাবে সেসব ল্যাবে প্রয়োজনীয় কারিগরি দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানান, ল্যাবগুলোতে আধুনিক সব ধরনের সুবিধা থাকলেও অবকাঠামো ও শিক্ষকসংকটের কারণে সেসব সুবিধা কাজে লাগাতে পারছেন না তাঁরা। অবকাঠামো সংকটের কারণে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের কমন রুম, শিক্ষকদের বসার কক্ষগুলোকে পাঠদানের কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করতে হচ্ছে। বর্তমানে এই ইনস্টিটিউটে পাঠদান হচ্ছে সকাল ও বিকেল দুই পালায়। তারপরও প্রতি পালায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ল্যাবে ব্যবহারিক, আর অর্ধেক শিক্ষার্থী গাদাগাদি-ঠাসাঠাসি করে তত্ত্বীয় ক্লাসের সুযোগ পাচ্ছেন।

সাব্বির শেখ, রিফাত হোসেনসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, শিক্ষক স্বল্পতার কারণে একজন শিক্ষককে প্রতিদিন স্বাভাবিক ১২টি ক্লাসের স্থলে দুই শিফটে দ্বিগুণ ক্লাস নিতে হচ্ছে। এতে পাঠদানে শিক্ষকেরাও যেমন মনোযোগ রাখতে পারেন না, শিক্ষার্থীরাও মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর বাইরে শিক্ষকসংকটের কারণে বাইরের অতিথি (গেস্ট) শিক্ষক দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হচ্ছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ মো. রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা শিক্ষকসংকট। এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা চেষ্টা করছি, শিক্ষার্থীরা যাতে মানসম্মত কারিগরি জ্ঞান অর্জন করেন। নিজেদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন।’