‘চানরাইতুর মজা ফুরাই গেইয়ি’

চাঁদ রাতে চট্টগ্রামের ঈদ বাজারে উপচে পড়া ভিড়ফাইল ছবি।

সেকালের ঈদে ‘চানরাইত’ খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চানরাইত মানে চাঁদরাত; অর্থাৎ যে রাতে ঈদের চাঁদের দেখা মেলে। চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে শিশু-কিশোর ও তরুণেরা আনন্দে রাস্তায় নেমে পড়তেন। বাজি পোড়াতেন, হইচই করতেন। চট্টগ্রাম নগরের আদি বাসিন্দা, যাঁদের ‘শউরগা’ বলা হতো। বিশেষ করে বাংলাবাজার, কদমতলী, বাকলিয়া, চর চাক্তাই, বহদ্দারহাট, ঘাটফরহাদবেগ, পাথরঘাটা, বকশীরহাট এলাকার মানুষেরা পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন পরিবার নিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে যেতেন ঈদের বাজার করতে। অনেক রাতে তাঁরা ঘরে ফিরতেন।

ঈদের চাঁদ উঠলে তড়িঘড়ি করে বাজারে যাওয়ার এই অভ্যাস কেন, তার কোনো সদুত্তর সেকালের মানুষের কাছে পাওয়া যায়নি। জানতে চেয়েছিলাম চাক্তাই এলাকার পুরোনো বাসিন্দা ইসমাইলের কাছে। তিনি বললেন, ‘আমাদের বাপ-দাদারা কেন এটা চালু করেছেন, জানি না। তবে এই চাটগাঁ শহর একসময় ব্যবসার দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নদীপথে, সড়কপথে সারা দেশ থেকে মানুষ এখানে আসতেন ঈদের বাজার করতে। তাঁরা বাজার করে ঈদের এক-দুই দিন আগে চলে যেতেন। ঈদের এক-দুই দিন আগে শহর ফাঁকা নির্জন হয়ে পড়ত। সেই সুযোগে ঈদের কেনাকাটা করতেন আমাদের বাপ-চাচারা।’

বাকলিয়ার বাসিন্দা হাঁচি মিস্ত্রিকে ‘চানরাইতের’ কথা বলতেই কিছুটা উদাস হয়ে গেলেন। বললেন, ‘চানলাতিয়ার (চাঁদরাতের) মজা আগের ডইল্লা (মতো) নাই। চান উডনর (ওঠার) লগে লগে আঁরা লিক্সা এককান লই লেয়াজুদ্দিন বাজার যাইতামগুই। যিয়ান যেডে ফাই, ইয়ান লই চলি আইসতাম। হতো বাজি পুড়াই, চানরাইতের মজা এখন ফুরাই গেইয়ি।’

হাঁচি মিস্ত্রি জানালেন, চাঁদরাতে পুরুষেরা ছোটদের নিয়ে বাজারে চলে যেতেন। আর নারীরা তড়িঘড়ি করে নারকেল ভাঙতেন। বাদাম ভাজতেন। তারপর দুধ দিয়ে সেমাই রাঁধতেন। আধঘণ্টার মধ্যে সেমাই তৈরি হয়ে যেত। সেই সেমাই খেয়ে তাঁরা চলে যেতেন বাজারে।

গত শতকের ষাট, সত্তর, আশির দশকের কথা স্মরণ করে নন্দনকানন নিবাসী রিয়াজ বলেন, ‘আমাদের চানরাতে তখন মসজিদ কমিটি একটা চোঙা নিয়ে ঘোষণা দিত সকালে কয়টা ঈদের জামাত হবে। তখন ঈদের বড় জামাত হতো আন্দরকিল্লাহ শাহি জামে মসজিদে। চানরাতে বকশীরহাট, রেয়াজুদ্দিন বাজার, নিউমার্কেট এলাকার ভিড় থাকত। তারা প্রায় ভোর পর্যন্ত দোকানপাট খোলা থাকত।’

এদিকে বাড়িতে নারীদের চোখে ঘুম থাকত না। তাঁরা ঘরদোর পরিষ্কার করতেন। নানা মিষ্টি-জাতীয় পিঠাপুলি বানাতেন। পাথরঘাটার ষাটোর্ধ্ব নাজিম জানান, বাড়ির নারীরা মচমচে মরিচ্চা পিঠা, চুটকি পিঠা, গুঁড়া পিঠাসহ নানা রকমের পিঠা বানানোর আয়োজন করতেন। তিনি জানালেন, তখন পাড়া বা মহল্লাভিত্তিক সমাজ ছিল। ঈদের জামাত, তারাবিহসহ অনেক আয়োজন হতো মহল্লাভিত্তিক। কোনো কোনো সময় সবাই মিলে ‘ডেক’ পাকাতেন। ডেক পাকানো মানে বড় একটা ডেকচিতে পাড়ার সবার জন্য খাবার তৈরি করা। সেটা বেশির ভাগ ছিল আকনি বিরিয়ানি অথবা ফিরনি। পাড়ার সবার ঘরে ঘরে সেটি বিলি করা হতো। সে এক অপরিমেয় আনন্দ।