হেঁশেল, বৈঠা দুই–ই সামলান সাজিদা

নৌকায় মানুষ পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করেন সাজিদা খাতুন। বৃহস্পতিবার বেলা দুইটার দিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে গোলাখালি গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

দেশের রাজনীতি, হরতাল-অবরোধ কিংবা জ্বালাও–পোড়ায়ের খবর রাখেন না সাজিদা খাতুন। সকাল থেকে শুরু হয় তাঁর খেয়া পারাপার। চলে রাত পর্যন্ত। কখনো কখনো নৌকায় বৈঠা রেখে ছুটে যান বাড়িতে রান্নাসহ অন্য কাজে। নৌকায় মানুষ পারাপার করে জীবন চলে এই নারীর।

সাজিদা খাতুনের (৩২) বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের মাদার নদীর তীরে কালিঞ্চি গ্রামে। সুন্দরবনসংলগ্ন গোলাখালি আর কালিঞ্চি গ্রাম আলাদা করেছে মাদার নদী। গোলাখালি গ্রামটি একেবারে সুন্দরবনের বুকের মধ্যে অবস্থিত। প্রায় ৯০০ বিঘা গ্রামটির আয়তন। ৮৮টি পরিবারে লোকসংখ্যা ৬০০ জন। গ্রামে কোনো দোকানপাট কিংবা প্রতিষ্ঠান নেই। প্রায় সাড়ে আট শ বিঘার জমির মালিক অন্য এলাকার মানুষ। তাঁরা এসব জমিতে মাছ চাষ করেন।

ভেটখালি থেকে নদীপথে অথবা কালিঞ্চি থেকে মাদার নদী পার হয়ে গোলাখালি যেতে হয়। কালিঞ্চি-গোলাখালি মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত মাদার নদীতে খেয়া পারাপার করেন সাজিদা খাতুন। প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি এই কাজ করছেন। মাদার নদী পার হওয়ার সময় গত বৃহস্পতিবার বেলা দুইটার দিকে নৌকায় বসে কথা হয় সাজিদার সঙ্গে। তিনি জানালেন, এলাকায় কাজ না থাকায় পাঁচ মাস আগে তাঁর স্বামী ফারুক গাজী গেছেন ভারতে কাজের সন্ধানে। দুই মেয়ে নিয়ে মাদার নদীর চরে কালিঞ্চি গ্রামে খাসজমিতে বসবাস তাঁদের। বড় মেয়ে ফারহানা খাতুন পড়ে কালিঞ্চি আবদুল গফ্ফার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এইচএসসি পাস করার পর তাকে নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা করানোর ইচ্ছা তাঁর। ছোট মেয়ে সোমা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে স্থানীয় আকবর আলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত নদীতে থাকতে হয় সাজিদা খাতুনকে। মাঝখানে শাশুড়ি পিরু বিবির কাছে বৈঠা ছেড়ে দিয়ে রান্না করতে যান। পাঁচ মাস আগে স্বামী ভারতে গেলেও আর যোগাযোগ করেননি। তাই খরচাপাতি দেওয়ার প্রশ্নও আসে না। চারজনের সংসার। দুই মেয়ে লেখাপড়া করে। সব মিলিয়ে তাঁদের মাসে ব্যয় হয় ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। গোলাখালির মানুষ পারাপারের জন্য তিনি মাসে পাঁচ হাজার করে পান। আর বাইরের লোকজন গ্রামে এলে তাঁদের কাছ থেকে পার হওয়ার জন্য জনপ্রতি নেন পাঁচ টাকা। এতে দিনে ৩০ থেকে ৬০ টাকা আয় হয়। সব মিলিয়ে দুমুঠো খেয়ে কোনো রকমে সংসার চলে তাঁর।

খোলাখালি গ্রামের বাসিন্দা জামিরুল ইসলাম বলেন, রাত আটটার পর গ্রামের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁদের দুগর্তির সীমা থাকে না। গ্রামে কোনো চিকিৎসক নেই। নেই কোনো ওষুধের দোকান। প্রাথমিকভাবে চিকিৎসক দেখানো কিংবা ওষুধ কেনার জন্য যেতে হয় আট কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ভেটখালি বাজারে। তাঁরা বাজার করেন সপ্তাহে এক দিন।

সাজিদা খাতুন লেখাপড়া করেছেন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। দেশের হরতাল-অবরোধ কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়ে কোনো খবর রাখেন না। সাজিদা শুধু বললেন, সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চললে দেশ ভালো চলে। মানুষ ব্যবসা করতে পারলে হাতে টাকা থাকে। মানুষ তাঁদের এলাকায় বেড়াতে আসে। তখন নদী পার হয়ে গোলাখালি আর সুন্দরবন দেখতে এলে তাঁর আয় বাড়ে। তখন একটু ভালো থাকতে পারেন।