বহুতল ভবন–স্টেডিয়াম নির্মাণ, আছে এসি বগির প্রতিশ্রুতিও

গানে গানে ভোট চাচ্ছেন এক প্রার্থী। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেলস্টেশনেছবি: জুয়েল শীল

ভোটে জিততে কেউ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের আবাসনসংকট সমাধানে বহুতল ভবন নির্মাণের, কেউ আবার বলছেন শাটল ট্রেনেই থাকবে এসি বগি। শহর পর্যন্ত চলবে বাস। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন্ন চাকসু নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন প্যানেলের ইশতেহারে মূলত এসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এক বছরের মধ্যে এসব কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, সে প্রশ্ন রয়েছে।

ইশতেহার নিয়ে ১০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা বলছেন, এক বছরের মধ্যে বহুতল হল নির্মাণ বা হাসপাতালের শয্যা বাড়ানোর কথা বলা মানে ‘কল্পনা’ ছাড়া কিছুই নয়। কারণ, এসব অবকাঠামো নির্মাণ চাকসুর দায়িত্ব নয়, এটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব। আর টাকা ছাড় দেয় সরকার। নানা ধাপ পেরিয়ে এ বরাদ্দ আদায় করে নিতে হয়। ফলে এক বছরের মধ্যে এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। তবে প্রার্থীরা যুক্তি দিচ্ছেন, চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁরা প্রশাসনকে দাবি আদায়ে বাধ্য করবেন।

লোকপ্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সিয়াম আল জাকি প্রথম আলোকে বলেন, এমন কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, যা ইশতেহারগুলোতে রাখা হয়নি। মনে হচ্ছে এক বছরেই সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবে চাকসু।

১৫ অক্টোবর সপ্তম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে লড়ছে ১৩টি প্যানেল। এখন পর্যন্ত ৯টি প্যানেল ইশতেহার ঘোষণা করেছে। এতে দফা রয়েছে ১৭০টি। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ ও ইসলামী ছাত্র মজলিস-সমর্থিত ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ এবং ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ নামের দুই প্যানেল ইশতেহার ঘোষণা করে। দুই ইশতেহারেই শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন ও একাডেমিক জবাবদিহি নিশ্চিতের অঙ্গীকার করা হয়েছে।

৯ প্যানেলের ইশতেহার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের যত রকমের সমস্যা ও সংকট রয়েছে, প্রায় সবই তুলে আনা হয়েছে। অবকাঠামো ছাড়াও গণতান্ত্রিক ও নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দেওয়া, ক্যাম্পাসে চাকরির ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন দফা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মহিম ইফতি বলেন, দফাগুলো শুনতে বেশ ভালো। কিন্তু এক বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন অসম্ভব।

চাকসুর কাজ কী?

চাকসুর গঠনতন্ত্রের ভূমিকায় বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম, যা তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান, সামাজিক সংযোগ বৃদ্ধি এবং সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি করে। এটি শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং ক্যাম্পাসের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

গঠনতন্ত্রে চাকসুর ৯টি কার্যাবলি তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীদের অধিকার, চাহিদা ও সমস্যাগুলো প্রশাসন এবং শিক্ষকদের কাছে উপস্থাপন করা। শিক্ষার্থীদের গবেষণা, পরিবেশ, উদ্ভাবন, মানবাধিকার, স্বাস্থ্যসেবা, যোগাযোগ ও আবাসনসংক্রান্ত বিষয়ে ভূমিকা রাখা এবং সামাজিক সম্মেলন, নাটক, সংগীতানুষ্ঠানসহ অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্যাম্পাসে আবাসনসংকট রয়েছে। নতুন আবাসিক হল দরকার। শাটল ট্রেনের বগি বাড়ানো দরকার। কিন্তু এসব সমস্যার সমাধান করবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। চাকসুর কার্যক্রম কী হবে, তা গঠনতন্ত্রে স্পষ্ট করে বলা আছে। গঠনতন্ত্রবহির্ভূত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের এখতিয়ার যাঁরা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তাঁদের নেই। নির্বাচিত হয়ে আসা প্রতিনিধিরা প্রশাসনকে নিয়মিত তাগাদা দেবে। সংকটের সমাধান আদায় করে নেবে। এটিই প্রত্যাশিত। নতুন ভবন নির্মাণ কিংবা চিকিৎসাকেন্দ্রের শয্যা বাড়িয়ে হাসপাতালে রূপান্তর করা চাকসুর কাজ নয়। ফলে আকাশকুসুম প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে জেতা যাবে না।

কার ইশতেহারে কী আছে

শুরুতেই ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের ইশতেহারে চোখ রাখা যাক। তাদের ইশতেহারে ৯টি মূল বিষয় রাখা হয়েছে। দফা দেওয়া হয়েছে ৩৩টি। মোটামুটি প্রায় সব সংকটের সমাধান রাখা হয়েছে। নির্বাচনে জিততে পারলে তারা ১২ মাসে এসব দফা বাস্তবায়ন করতে পারবে বলে মনে করে।

এ প্যানেলে ইশতেহারের প্রথম দফায় আবাসনসংকট নিরসনের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নির্বাচিত হলে বিদ্যমান হলগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও এক্সটেনশন ব্লক বৃদ্ধি এবং নতুন টিনশেড নির্মাণের মাধ্যমে বর্তমান অনাবাসিক শিক্ষার্থী সংখ্যার ন্যূনতম ১০ শতাংশ আসন বৃদ্ধি করবে তারা। পাশাপাশি স্থায়ী সমাধান হিসেবে অধিক শিক্ষার্থী ধারণক্ষমতাসম্পন্ন বহুতল আবাসিক হল নির্মাণ করা হবে। অবশ্য ছাত্রশিবিরের প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মো. ইব্রাহিম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে। এক বছরের মধ্যে হয়তো সব দফা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। যেমন বহুতল ভবন নির্মাণ করা সম্ভব না-ও হতে পারে। তবে কিছু টিনশেড ঘর নির্মাণ করে আবাসনসংকট নিরসন করা যাবে।

অন্যদিকে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের ইশতেহারে দফা রয়েছে ৮টি। এতে বলা হয়েছে, নির্বাচিত হতে পারলে শাটল ট্রেনে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) বগি সংযোজনের জন্য তারা কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। পাশাপাশি শাটল ট্রেনের দ্বিমুখী চলাচল নিশ্চিত করতে ডাবল লাইন স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রটি ১০০ শয্যার হাসপাতালে রূপান্তরের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা তারা নেবে।

ছাত্রদলের প্যানেলের ভিপি প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে ভবিষ্যতের একটি পথনকশা তৈরি করেছেন। এতে মাত্র ৮টি বাস্তবসম্মত দফা রাখা হয়েছে। এসব দফার সবকিছুই হয়তো এক বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। তবে আরও পরে যাঁরা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তাঁদের জন্য এটি দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করবে।

অন্যদিকে জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সংগঠন স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি (স্যাড) ও ছাত্র ফেডারেশন-সমর্থিত বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্যের ৭ দফা ইশতেহারে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠকে তারা স্টেডিয়ামে রূপান্তর করবে। অলিম্পিক মানের সুইমিংপুলও নির্মাণ করবে তারা। পাশাপাশি তারাও নতুন হল নির্মাণের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ইশতেহার শ্রুতিমধুর হলেও বাস্তবায়নের প্রশ্নে বাস্তবতা ভিন্ন—এমন মত দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. বখতেয়ার উদ্দিন। তিনি বলেন, ভবন নির্মাণ কিংবা শাটল ট্রেন দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের এখতিয়ার। তবে শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে দাবি জানাতে পারে। চাপ দিয়ে সে দাবি আদায় করে নিতে পারে। এর বাইরে এসব অবকাঠামো নির্মাণ করা চাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধির কাজ নয়।