সেতু না হওয়ায় দুর্ভোগ

প্রায় ৪০০ ফুট দৈর্ঘ্যের এই সাঁকোর দেখা মিলবে উপজেলার পরমেশপুর এলাকায় ঢেপা নদীর ওপরে।

নদী পারাপারে শুষ্ক মৌসুমে সাঁকো এবং বর্ষাকালে নৌকা ভরসা। ১৫টি গ্রামের ১০ হাজারের বেশি মানুষ দুর্ভোগে রয়েছে। গত রোববার দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের পরমেশপুর এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

নদী পারাপারে শুকনা মৌসুমে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভরসা বাঁশের সাঁকো। বর্ষা মৌসুমে দুটি নৌকা। নদীর দুই পারের ১৫টি গ্রামের ১০ হাজারের বেশি মানুষ সেখানে চলাচল করেন। মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল পার হয় দুই সহস্রাধিক। তবে পারাপার হওয়া লোকজনের এক–তৃতীয়াংশই ঘাট ইজারাদারকে দৈনিক ভাড়া পরিশোধ করেন না। অপেক্ষায় থাকেন হালখাতার। হালখাতায় পরবর্তী এক বছরের ভাড়া দিয়ে দেন তাঁরা।

প্রায় ৪০০ ফুট দৈর্ঘ্যের এই সাঁকোর দেখা মিলবে দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের পরমেশপুর এলাকায় ঢেপা নদীর ওপরে। ঘাটের ইজারাদার সুধীর চন্দ্র রায় (৫৮)। প্রায় ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে ঘাট ইজারা নিচ্ছেন তিনি। এবার ৪০ হাজার টাকায় ইজারা নিয়েছেন। সুধীর চন্দ্র রায় বলেন, এলাকার মানুষ সবাই পরিচিতজন। প্রতিদিন ভাড়া চাওয়া যায় না। তাই প্রতিবছর পৌষ মাসের প্রথম সপ্তাহে আমন ধান কাটা ও মাড়াই হলে পরমেশপুর ঘাটে এলাকার মানুষকে দাওয়াত করেন। সেদিন পুরি-জিলাপি-নিমকি খাওয়ান তাঁদের। কেউ ২০০-৫০০ টাকা দেন। কেউ দেন ১০ কেজি থেকে আধা মণ ধান। তবে আর খেয়াঘাট করতে চান না সুধীর চন্দ্র।

ঢেপা নদীর দৈর্ঘ্য ৪০ কিলোমিটার। স্থানভেদে ১০০-১৫০ মিটার চওড়া। খানসামা উপজেলার জয়ন্তীয়া এলাকায় আত্রাই নদী থেকে ঢেপার উৎপত্তি। এটি বীরগঞ্জ-কাহারোল-বিরল উপজেলা হয়ে সদর উপজেলার রাজাপাড়া ঘাট এলাকায় পূনর্ভবা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে।

গত রোববার বিকেলে পরমেশপুর ঘাট এলাকা ঘুরে দেখা যায় নদীর এক পাড় থেকে আরেক পাড়ের দূরত্ব প্রায় এক হাজার ফুট। নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় আড়াআড়িভাবে বাঁশের বাতা দিয়ে ৪০০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি সাঁকো তৈরি করা হয়েছে। এর ওপর দিয়ে চলাচল করছে মানুষ, মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল। ঘাটপাড়ের মানুষ জানান, ভোর হতে রাত ১২টা পর্যন্ত ঘাট দিয়ে মানুষ ও যানবাহন চলাচল করে। নদীর দুই পাড়ে এলজিইডি যাত্রীছাউনি নির্মাণ করেছে।

এলজিইডি থেকে ২৮০ মিটার সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে মাটি পরীক্ষা, ড্রইং ও নকশার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
ফিরোজ আহমেদ, উপজেলা প্রকৌশলী

নদীর পূর্ব পারে পরমেশপুর গ্রামের একাংশ, গড়নুরপুর, ইটুয়া, তেরমাইল, দশমাইল ও ফার্মেরহাট গ্রাম। রয়েছে নিত্যানন্দ দাতব্য চিকিৎসালয় ও নিত্যানন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়। নদীপাড়ের সঙ্গে লাগোয়া আশ্রমপাড়া। আর পশ্চিমে পরমেশপুর গ্রামের একাংশ, ইশ্বরগ্রাম, ফুলতলা, মোল্লাপাড়া, মুটুনি, ডাঙ্গাপাড়া ও ফেফসাডাঙ্গা গ্রাম। পশ্চিমপারে নদীর সঙ্গে লাগোয়া পরমেশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

এসব গ্রামের ১০ হাজারের বেশি মানুষ ঘাট দিয়ে চলাচল করেন। বর্ষাকালে দুর্ভোগ বেশি হয়। গত কয়েক বছরে দুজনের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। একটি সেতুর জন্য দীর্ঘদিনের অপেক্ষা স্থানীয় বাসিন্দাদের। দশমাইল এলাকায় সেলুনে কাজ করেন কুশল চন্দ্র। তিনি বলেন, ‘প্রায় সময়ত রাইত ১০-১১টায় বাড়িত যাই। এমপি সাহেবক হামরা বহুতবার কহেচি এইঠেনা একটা ব্রিজ দরকার। খালি কহেচে মাথায় রাখচে, হচে, হচে, হবে। পাশের গ্রামোত তেলমাখার ঘাটোত ব্রিজ হইলো। ওইঠেকার চাইতে এইঠেনা ব্রিজটা বেশি দরকার আছলো।’

নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে ১০-১২টি তিন চাকার যানবাহন। পারাপার হওয়া লোকজনকে গন্তব্যে পৌঁছে দেন তাঁরা। ভ্যানচালক রিয়াজ উদ্দিন (৫০) বলেন, ঘাটের পূর্বপাড়ের মানুষকে যদি উপজেলায় যেতে হয়, তাহলে কান্তনগর দশমাইল, কান্তনগর মোড় হয়ে প্রায় ১৫ কিলোমিটার ঘুরতে হয়। সেতুটি হলে ছয় কিলোমিটার রাস্তা কমবে। আবার পূর্বপাড়ের মানুষকে জেলা শহর কিংবা সৈয়দপুর, বীরগঞ্জ যেতে হলে ১৬-১৮ কিলোমিটার যেতে হয়। সেতু হলে পূর্বপাড়ের মানুষেরও রাস্তা কমবে আট কিলোমিটার।

রিয়াজ উদ্দিন আরও বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘাট এলাকায় থাকেন। তাতেই ৪০০-৪৫০ টাকা ভাড়া পান। তবে রাত বেশি হলে অনেক সময় ভ্যান থাকে না। তখন যাত্রীদের ভীষণ কষ্ট হয়। চার কিলোমিটার হেঁটে মুটুনি বাজারে যেতে হয়। যাত্রীদের অনেকের কাছে তাঁর ফোন নম্বর দিয়ে রেখেছেন।

পরমেশপুর গ্রামকে দুই ভাগ করেছে ঢেপা নদী। নদীর পূর্বপাড়ে আশ্রমপাড়ায় ৮০টি পরিবারের বসবাস। সেখানকার বাসিন্দা নবদ্বীপ কুমার বলেন, ‘১০ বছর থাকিয়া ইলেকশন করছে এমপি সাহেব। তাহো কহচে ব্রিজ হবে। এখন আরও ইলেকশন আইচ্ছে এমপি সাহেব খালি দুনিয়ার লোক পাঠায় দিচ্ছে। সাত বার নাপানাপি করে নিগাছে। কয়েকদিন আগেও লোক আসিয়া নাপে নিগাইল। এখন যে কদ্দুর কি ওইটা তো হামরা কহিবার পারি না।’

সেতু নির্মাণের বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলী ফিরোজ আহমেদ বলেন, পরমেশপুর এলাকায় ঢেপা নদীর ওপরে এলজিইডি থেকে ২৮০ মিটার সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে মাটি পরীক্ষা, ড্রইং ও নকশার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ থেকে একটা সম্মতিপত্র নিতে হয়। তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে। প্রত্যয়নপত্র পেলে দরপত্র আহ্বান করা হবে।