পুরোনো সেই বন্ধুদের ভালোবাসায় নির্ভার প্রয়াত খাদেম আলীর পরিবার

বগুড়ার প্রয়াত খাদেম আলী শেখের পরিবারকে অটোরিকশা উপহার দিচ্ছেন ক্যাম্পাস জীবনের বন্ধুরা
ছবি: প্রথম আলো

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছেড়েছেন ৫১ বছর আগে। বয়স পেরিয়েছে সত্তরের কোঠায়। অনেকেই সরকারি-বেসরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। কিন্ত তাঁরা ভুলে যাননি বন্ধুত্বের মায়া। সেই মায়ার টানে প্রয়াত এক বন্ধুর পরিবারের পাশে দাঁড়ালেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ ব্যাচের একদল শিক্ষার্থী।

বগুড়া শহরের মালতিনগর এলাকার বাসিন্দা খাদেম আলী শেখের মৃত্যুতে অন্ধকার নেমে এসেছিল পরিবারে। পরিবারের হাল ধরেছিলেন তাঁর ছেলে নাজমুল ইসলাম। তিনিও দুর্ঘটনায় আহত হলে চিকিৎসা খরচ আর ঋণের চাপে প্রায় নিঃস্ব হতে বসেছিল পরিবারটি। তবে খাদেম আলীর পুরোনো সেই বন্ধুরা তা হতে দেননি। দুর্ঘটনায় আহত নাজমুলকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। এরপর গতকাল বুধবার প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা উপহার দিয়েছেন বন্ধুরা। বন্ধুত্বের এমন বিরল ভালোবাসায় নির্ভার খাদেম আলী শেখের পরিবার।
খাদেম আলী বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদ থেকে পাস করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে ভেটেরিনারি সার্জন পদে যোগ দেন। টাঙ্গাইলে কর্মরত থাকা অবস্থায় ২০০৭ সালে তিনি মারা যান।

খাদেম আলীর সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের সদস্য অধ্যাপক এম গোলাম শাহী আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করে তাঁরা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ষষ্ঠ ব্যাচে ভর্তি হয়েছিলেন। তারুণ্যের ওই সময়ে সহপাঠীদের সঙ্গে অন্য রকম বন্ধুত্ব হয়েছিল। ভেটেরিনারি অনুষদে পড়ত খাদেম আলী শেখ। ওর সঙ্গে ক্যাম্পাসে জমিয়ে আড্ডা দিতেন। পড়াশোনা শেষে সবাই কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। খাদেম আলী শেখ যোগ দিলেন ভেটেরিনারি সার্জন পদে। খুব একটা যোগাযোগ ছিল না ওর সঙ্গে। ২০০৭ সালে সরকারি চাকরিতে কর্মরত অবস্থায় মারা গেলেন। সেই খবর বন্ধুদের কাছে পৌঁছাল অনেক পরে।

খাদেম আলীর অবর্তমানে তাঁর পরিবারের দুর্দশার কথা বন্ধুরা জানতে পারলেন আরও পরে। গোলাম শাহী আলম বলেন, ব্যাংক ঋণ নিয়ে বগুড়ায় একটা বাড়ি করেছিলেন খাদেম। পরিবারের ওপর ছিল ঋণের চাপ। সংসারের দায়িত্ব কাঁধে পড়ে ওর ছেলে নাজমুল ইসলামের ওপর। বছর কয়েক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্বক আহত হন নাজমুল। উপার্জন বন্ধ হয়। খাদেমের স্ত্রীও নানা রোগে আক্রান্ত। একদিকে চিকিৎসার খরচ, অন্যদিকে সংসারের ভরণপোষণ সব মিলিয়ে পরিবারে অন্ধকার নেমে আসে।

গোলাম শাহী আলম বলেন, এরপর কয়েক বন্ধু মিলে নানাভাবে খাদেমের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগে নেন। অসুস্থ নাজমুলকে চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠানো হয়। চিকিৎসায় বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। বন্ধুরা মিলে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। দুর্দশাগ্রস্ত পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর জন্য দেশ-বিদেশে থাকা কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ১৪ থেকে ১৫ জন বন্ধু ছাড়াও তাঁদের স্বজন, পরিচিত কয়েকজনও সহযোগিতার হাত বাড়ান। সবার সহযোগিতায় প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকায় সিএনজিচালিত নতুন একটি অটোরিকশা উপহার কেনা হয়।

গতকাল খাদেম আলীর স্ত্রী নার্গিস বেগম এবং ছেলে নাজমুল ইসলামের কাছে উপহারের অটোরিকশা হস্তান্তরের সময় এম গোলাম শাহী আলম ছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং ফিনলে চা–বাগানের সাবেক ব্যবস্থাপক জামাল আহমেদ চৌধুরী, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের সাবেক পরিচালক আবদুল্লাহেল বাকী, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের সাবেক পরিচালক সাইফুল আলম খান চৌধুরী, গ্রাম উন্নয়ন সংস্থার (গাক) সিনিয়র পরিচালক মাহবুব আলমসহ বেশ কয়েকজন বন্ধু উপস্থিত ছিলেন।

বন্ধুর পরিবারের প্রতি সহপাঠীদের এ বিরল ভালোবাসায় মুগ্ধ খাদেম আলীর স্ত্রী নার্গিস বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলের চিকিৎসা, আমার নিজের চিকিৎসা ছাড়াও সংসারের খরচ সংকুলান করতে নিঃস্ব হওয়ার মতো অবস্থা। অনাহারে–অর্ধাহারে দিন কাটছে আমাদের। দুঃসময়ে খাদেমের প্রতি বন্ধুত্বের অনন্য ভালোবাসার উপহার হিসেবে তাঁরা (বন্ধুরা) যে সিএনজি উপহার দিলেন, সেই ভালোবাসার ঋণ কখনো শোধ হওয়ার নয়।’