‘এত দিন কোথায় ছিলি, কী খবর বল?’

গান–কবিতা–আড্ডায় দীর্ঘ ৬২ বছর পর প্রথম পুনর্মিলনী উৎসব করেছেন কক্সবাজার সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রীরা। শুক্রবার দুপুরে শহরের গোলদিঘির পাড়ে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি জেলার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ৬২ বছরে বিদ্যালয়টিতে প্রাক্তন ছাত্রীদের কোনো পুনর্মিলনী হয়নি। ছাত্রীদের অনেকে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষক, সরকারি আমলা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যাংকার, উদ্যোক্তা। পাঁচ যুগ পর আজ তাঁরা বিদ্যালয়ে সমবেত হন সম্প্রীতির মেলবন্ধনে। বয়সে ছোট-বড় কিংবা পদমর্যাদা ভুলে সবাই গলা জড়িয়ে ধরে একে অপরের বলছেন, ‘এত দিন কোথায় ছিলি, কেমন আছিস, কী খবর বল?’

দীর্ঘ ৬২ বছর পর আজ শুক্রবার শহরের গোলদিঘির পাড়ে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হন ৪১টি এসএসসি ব্যাচের (১৯৬২-২০২১) ৮৫০ জন প্রাক্তন ছাত্রী। সকাল নয়টার আগেই বিদ্যালয়ের মাঠ ভরে যায় প্রাক্তনদের পদভারে। সবাই সেজেছেন এসএসসি সালভিত্তিক। কেউ লাল, আবার কেউ হলুদ ও গোলাপি শাড়ি পরা। চোখে কালো চশমা, মাথায় সবুজ টুপি। আনন্দ-উচ্ছ্বাস নিয়ে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে ও খোলা মাঠে বসে চলে অতীতের স্মৃতিচারণা।

উৎসবে অংশ নিতে চট্টগ্রাম থেকে ছুটে আসেন নিলুফা ইয়াসমিন। বাড়ি শহরের টেকপাড়ায়। ১৯৮৭ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাস করার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন। এখন চট্টগ্রামে শিক্ষকতার পাশাপাশি পথশিশুদের নিয়ে কাজ করছেন। সকালে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঢুকতেই পরিচিতজনেরা তাঁকে ঘিরে ধরেন। তারপর কথা শুরু, ‘কোথায় ছিলি রে এত দিন?’

সকাল সাড়ে নয়টায় জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে পুনর্মিলনী উৎসবের শুরু। বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আকতার। সকাল ১০টায় বের হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন উপাচার্য শিরীণ আকতার। বিদ্যালয়ের স্মৃতিচারণা করে উপাচার্য বলেন, ‘স্বাধীনতার পর আমি চট্টগ্রাম খাস্তগীর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে কক্সবাজার সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হই। এই স্কুল থেকেই এসএসসি পাস করি। জেলার শ্রেষ্ঠ একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছিলাম ভাবতে ভালো লাগে। যেখানে যাই এই স্কুলের স্মৃতি তুলে ধরি। আজ প্রাণের উৎসবে অংশ নিতে পেরে, পরিচিতজনদের সান্নিধ্য পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে।’

সকাল সাড়ে নয়টায় জাতীয় সংগীতের পর বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আকতার
ছবি: প্রথম আলো

১৯৬২ সালে বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন ১১ জন। তাঁদের মধ্যে আজকের উৎসবে অংশ নেন চারজন। তাঁদের একজন শহরের জয়নাব আকতার (৭৩)। তিনি বলেন, ‘বৃদ্ধ বয়সে এসে বিদ্যালয়ের প্রথম পুনর্মিলনীতে অংশ নিতে পেরেছি ভেবে আনন্দ লাগছে। সবাই বয়সে ছোট হলেও একই বিদ্যালয়ে পড়েছি—এই আনন্দ লুকানো যাচ্ছে না।’

পুনর্মিলনী উৎসব আয়োজনের আহ্বায়ক তানিয়া কাশেম বলেন, ‘অধিকাংশ ছাত্রী জেলার বাইরে থাকেন বলেই সম্ভবত এত দিন উৎসব হয়নি। ৬২ বছর পর আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজটি এগিয়ে নিতে পেরেছি। আশা করছি, ভবিষ্যতে এ ধরনের আয়োজন আরও হবে।’

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মাসুদা মোর্শেদা এ বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। এক যুগের বেশি সময় ধরে তিনি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। দেড় বছর ধরে তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে। মাসুদা মোর্শেদা বলেন, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, তার প্রমাণ এ পুনর্মিলনী উৎসব।

উৎসবে অংশ নিতে সুদূর টেকনাফের হোয়াইক্যং এলাকা থেকে ছুটে আসেন প্রাক্তন ছাত্রী পারভীন আকতার। তিনি হোয়াইক্যং স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক। পারভীন আকতার বলেন, সংসার ও কর্মজীবন নিয়ে তাঁরা সবাই ব্যস্ত থাকেন। মুঠোফোনে সময়-অসময়ে বন্ধুদের সঙ্গে এক-আধটু কথা হলেও ব্যতিক্রম এ উৎসব। এখানে নাচ-গান, আড্ডা, অতীতের স্মৃতিচারণা করেই কাটানো হলো একটি দিন। যেটি অন্য কোনো দিনে সম্ভব নয়।