পায়রাবন্দের আরেক আলো আছিরন

সংগ্রামী নারী আছিরন নেছা। নিজে স্বাবলম্বী হয়ে অন্যদেরও স্বাবলম্বী করে তুলছেন। বাড়ির ছাদে পাট দিয়ে নানা পণ্য তৈরি করার কাজ দেখিয়ে দিচ্ছেন নারীদের। সম্প্রতি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের জয়রামপুর গ্রামেছবি: মঈনুল ইসলাম

নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার বাড়ি যে পায়রাবন্দে, সেই পায়রাবন্দেরই মেয়ে আছিরন। বাল্যবিবাহ হয়েছিল মাত্র ৯ বছর বয়সে। এরপর তিনি তাঁর সাত বছর বয়সী মেয়ে কোহিনুরকেও বিয়ে দেন। তখন আছিরনের বয়স ১৮। মা ও মেয়ের বাল্যবিবাহের ঘটনা নব্বইয়ের দশকে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। সেই লজ্জা আর চোখের পানি নিয়ে আছিরন ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন আজ বাস্তব। সংসারের অনটন দূর করে তিনি শুধু নিজের দিনবদল করেননি, গ্রামের নারীদেরও স্বাবলম্বী করে তুলেছেন। পায়রাবন্দের কয়েকটি গ্রামের প্রায় ১৫০ নারীকে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মমুখী করে তুলেছেন আছিরন। পাট দিয়ে তাঁর তৈরি নানা পণ্য দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও যাচ্ছে।

আছিরনের কাজ সম্পর্কে জানেন রংপুর চেম্বারের সভাপতি মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আছিরন গ্রামের নারীদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন। তাঁর এই মহৎ উদ্যোগ এখনো অব্যাহত আছে। আছিরনেরাই দেশের ভবিষ্যৎ।

শুরুর কথা

১৯৯২ সালে স্থানীয় এক দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সুদে মাত্র চার হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন আছিরন। সেই ঋণের টাকা একসময় সুদাসলে দাঁড়ায় ১০ হাজারে। টাকা পরিশোধ করতে না পেরে গ্রাম থেকে চাকরির সন্ধানে চলে যান ঢাকায়; কিন্তু চাকরি জোটেনি। শেষমেশ তাঁর শাশুড়ি খোদেজা বেগম জমি বন্ধক রেখে ঋণের টাকা পরিশোধ করেন। এরপর তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। ১৯৯৪ সালে শাশুড়ি ৪ মণ ধান বিক্রির টাকা দিয়ে একটি সেলাই মেশিন কিনে দেন আছিরনকে। সেই সেলাই মেশিন দিয়ে টুকটাক কাজ করতে থাকেন তিনি। অল্প আয়ে কোনো রকমে অভাবের সংসার চলে যায়। পরের বছর জমানো মাত্র ছয় হাজার টাকা দিয়ে নতুন স্বপ্নের যাত্রা শুরু করেন। নিজে ও দুই মেয়েকে নিয়েই পাট দিয়ে হস্তশিল্পের পণ্য তৈরি করতে লাগলেন। তা দেখে গ্রামের অন্য নারীরাও এগিয়ে এলেন। বিনা মূল্যে ওই সময় নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটিও শুরু করেন আছিরন। তাঁর শৈল্পিক কাজ ও গুণের কথা ছড়িয়ে পড়ল আশপাশের গ্রামে। নারীদের প্রশিক্ষণ আর নিজ বাড়ির দুটি ঘরে হস্তশিল্প তৈরি করে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করছেন আছিরন। অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেই পণ্য জাপান, জার্মানি, ইতালিতেও যাচ্ছে। এভাবেই নিজের সঙ্গে দেড় শতাধিক নারীর জীবনমানও বদলে দিয়েছেন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের জয়রামপুর গ্রামের আছিরন নেছা (৫৮)।

কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই আছিরন হস্তজাত পণ্য বুননের কাজে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। পাট দিয়ে ঝুড়ি, পাপোশ, দোলনা, খেলনা, ব্যাগ, পুতুল, কলমদানি, হরিণসহ ছোটদের খেলনা তৈরি করতে শুরু করেন তিনি। এসব কাজে প্রথম সহায়তা করেন তাঁরই দুই মেয়ে কোহিনুর বেগম ও গোলেনুর বেগম। সেটি ২০০৭ সালের কথা। প্রচার পাওয়ায় পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। মা ও দুই মেয়ের কাজের পাশাপাশি ওই সময় গ্রামের ১০ নারীকে কাজ শিখিয়ে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।  

বাড়ির সামনে শোরূমে আছিরন নেছা। সম্প্রতি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের জয়রামপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

প্রতিষ্ঠানের যাত্রা ও প্রশিক্ষণ

হস্তশিল্প নিয়ে ২০০৭ সালে বগুড়ার নুনগোলার একটি বড় মেলায় অংশ নেন আছিরন। সেই মেলা থেকে কিছু লাভ হয়। সেই পুঁজির টাকায় গ্রামে ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। এবার প্রতিষ্ঠানের নাম দেন ‘অনেক আশা কুটির শিল্প’। দুই বছরের মধ্যে তাঁর প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৬–এ। পণ্যের উৎপাদন বাড়তে থাকে। পর্যায়ক্রমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুরসহ কিছু এলাকায় মেলায় অংশ নেন। প্রতি মেলা থেকে আয় হতে থাকে। এদিকে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে আছিরনের তৈরি পণ্য ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

আছিরন শুধু নিজের দিন বদল করেননি। পায়রাবন্দের জয়রামপুর, খোর্দ মুরাদপুর, তকেয়া, কেশবপুর, জোত ষষ্ঠি, জয়রামপুর ও ইসলামপুর গ্রামে ঘুরে ঘুরে নারীদের বিনা মূল্যে হস্তশিল্পের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। একেকটি দলে ভাগ করে নারীদের বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ দিতেন। একেকটি দলে ২৫ জন করে সদস্য থাকতেন। এমন করে ১৫০ নারীকে তিনি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই নিজেদের অবস্থান থেকে হস্তশিল্পের সঙ্গে কাজ করছেন। আবার অনেকে চাকরিও করছেন।

নিজে স্বাবলম্বী হয়ে অন্যদেরও স্বাবলম্বী করে তুলছেন। বাড়ির ছাদে পাট দিয়ে নানা পণ্য তৈরি করার কাজ দেখিয়ে দিচ্ছেন নারীদের। সম্প্রতি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের জয়রামপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

সরেজমিনে একদিন

পায়রাবন্দের জয়রামপুর গ্রামে আছিরনের বাড়িতে সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, মাত্র ৮ শতাংশ জমির ওপর বসতভিটা। আধা পাকা পাঁচটি টিনের ঘরে পাটপণ্য দিয়ে নারীরা বুননের কাজ করছেন। একটি পাকা ঘর আছে। সেটিকে শোরুম করা হয়েছে। শোরুমের ছাদেও নারীরা বসে কাজ করছেন।

কথা হলো কয়েকজন নারীর সঙ্গে। ওমেজা বেগম (৫০) আট বছর ধরে কাজ করছেন। সাত বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। এরই মধ্যে দুই ছেলেমেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন তিনি। ওমেজা বলেন, ‘এখানে এসে অনেক কাজ শিখেছি। কোনো টাকা লাগেনি। আছিরন আপার সঙ্গে কাজ করে যে টাকা পাই, তা দিয়ে সংসার ভালোভাবেই চলে যায়।’  

১০ বছর ধরে আছিরনের সঙ্গে কাজ করছেন কোহিনুর বেগম (৪০)। উপার্জিত টাকা দিয়ে তিন সন্তানকে লেখাপড়া করাচ্ছেন তিনি। আছিরন বলেন, ‘একসময় অনেক কষ্ট আছিল। কিন্তু আপার সাথে কাজ করিয়া সেই অভাব দূর হইছে। ছাওয়াগুলার ভালোভাবে লেখাপড়া করিবার পারছি। এই জায়গার আয় করিয়া স্বামীক একটা অটোরিকশা কিনি দিছি।’    

সহায়–সম্পত্তি সম্পর্কে আছিরন জানান, উপার্জনের টাকা দিয়ে ১২ শতাংশের একটি পুকুর কিনেছেন। সেখানে মাছ চাষ হয়। মেয়ে গোলেনুর বেগমকে ৮ শতাংশ জমি কিনে দিয়ে বাড়িঘর তৈরি করে দিয়েছেন। বসতভিটায় পাকা একটি শোরুম করেছেন। বাড়ির সামনে স্বামীকে একটি মুদিদোকান করে দিয়েছেন।

বিশিষ্টজনেরা যা বললেন

আছিরনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এমন এক ব্যক্তি পায়রাবন্দের রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগারের উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘একজন আছিরনই দেখিয়ে দিল কীভাবে বদলে যেতে হয়। নারীদের স্বাবলম্বী করতে আছিরনের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।’  
আছিরন গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছেন মন্তব্য করে পায়রাবন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহাবুবার রহমান বলেন, তাঁর হাত ধরে অনেকেই আজ কর্মমুখী। এভাবে তাঁর মতো নারীরা এগিয়ে এলে এই গ্রাম একদিন আরও আলোকিত হয়ে উঠবে।