উপকূলীয় জেলাগুলোর নদ–নদীসহ বিভিন্ন নৌপথে নৌযান চলাচল বন্ধ

ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে ঢাকার সদরঘাট থেকে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। আজ রোববার দুপুরে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথ, ভোলার সব নদ-নদী এবং ঢাকার সদরঘাট ও দোহার উপজেলার মৈনটঘাট থেকে নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। গতকাল শনিবার বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে সদরঘাট থেকে আজ রোববার সকাল থেকে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। গতকাল শনিবার রাত ১০টার দিকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত সদর দক্ষিণাঞ্চলের ৪১টি রুটের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে ৪৬টি লঞ্চ। আর সদরঘাটে এসেছে ৫৮টি লঞ্চ। তবে আজ সকাল থেকে সদরঘাটে আসা বেশ কয়েকজন যাত্রী লঞ্চ না পেয়ে সড়কপথে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন।
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থেকে আসা মর্জিনা বেগম বলেন, ‘সকাল সাড়ে আটটার দিকে ট্রেন থেকে নেমেছি। এরপর সকাল ১০টার দিকে সদরঘাটে চলে আসি। এখানে এসে দেখি লঞ্চ চলাচল বন্ধ। তাই সড়কপথে আমতলীর উদ্দেশে রওনা দেব।’

রোববার দুপুর ১২টার দিকে সদরঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, চাঁদপুর রুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলো সদরঘাটের পন্টুনে নোঙর করে রাখা হয়েছে। চাঁদপুরগামী এমভি ঈগল লঞ্চের সুপারভাইজার সেলিম মিয়া বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে লঞ্চ চলাচল বন্ধ আছে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলে পুনরায় লঞ্চ চলাচল শুরু করবে।

হাতিয়াগামী এমভি তাসরিফ-২ লঞ্চের কর্মচারী সিরাজুল ইসলাম জানান, আজ হাতিয়া যাওয়ার কথা ছিল। আবহাওয়া খারাপ হওয়ার কারণে সরকার লঞ্চ চলাচল বন্ধ রেখেছে। তাই টার্মিনালে লঞ্চ নোঙর করে রাখা হয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের ঢাকা নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক ইসমাইল হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবের কারণে ঢাকা নদীবন্দরে ৪ নম্বর মহা বিপৎসংকেত রয়েছে। যাত্রীদের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে গতকাল শনিবার রাত ১০টা থেকে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এই নির্দেশ বলবৎ থাকবে।

রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথে আজ সকাল পৌনে ১০টা থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। নদী উত্তাল থাকায় যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে বিআইডব্লিউটিএ এর আগেই লঞ্চ বন্ধ ঘোষণা করে। এ নৌপথের যাত্রীদের ফেরিতে নদী পারাপার হতে অনুরোধ করেছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে দমকা হাওয়া শুরু হওয়ায় রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া–পাটুরিয়া নৌপথে আজ রোববার সকাল থেকে সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

আরিচা লঞ্চ মালিক সমিতি দৌলতদিয়া ঘাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক নুরুল আনোয়ার মিলন বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী আগের দিন শনিবার দিবাগত রাত ৯টার পর থেকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে সব ধরনের লঞ্চ বন্ধ ছিল। রাত শেষে আজ সকাল সোয়া ছয়টা থেকে পুনরায় লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক হয়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন নৌপথ বন্ধ হলেও আমাদের এই পথে লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে প্রবল বাতাস শুরু হলে নদী উত্তাল হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে দুর্ঘটনা এড়াতে সকাল পৌনে ১০টা থেকে এই নৌপথের সব লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দিই। এর আগ পর্যন্ত এই রুটে ছোট-বড় মিলিয়ে ১৭টি লঞ্চ ছিল। লঞ্চগুলোকে ঘাটের অদূরে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখা হয়েছে।’

দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, পদ্মা নদী উত্তাল থাকলেও যানবাহনবোঝাই ফেরিগুলো ধীরগতিতে নদী পাড়ি দিচ্ছে। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে তেমন যানবাহন দেখা না গেলেও নদী পাড়ি দিতে আসা কিছু গাড়ি ঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। এ ছাড়া লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় ঘাট থেকে একটু দূরে নিরাপদ স্থানে লালু মণ্ডলপাড়ায় লঞ্চগুলোকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। ফাঁকা পন্টুন পড়ে আছে।

বিআইডব্লিউটিএর দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক পরিদর্শক মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘সকাল থেকে নৌপথে সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখার কথা বলা হয়। তবে এই নৌপথ অনেকটা স্বাভাবিক থাকায় লঞ্চ মালিক সমিতি লঞ্চ চলাচল অব্যাহত রাখে। তাদেরকে পুনরায় বন্ধ রাখার তাগিদ দিলে সকাল ৯টার পর চূড়ান্তভাবে তারা লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়। অনেক সময় আছে আমাদের পক্ষ থেকে বলার পরও স্থানীয়ভাবে তারা নদীর অবস্থা বুঝে লঞ্চ চলাচল অব্যাহত রাখে।’

ভোলার সব নৌপথে লঞ্চ ও ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। ভোলা নদীবন্দরের উপপরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, বিআইডব্লিউটিএর নির্দেশে ভোলার সব নৌপথে লঞ্চ, ফেরি, স্পিডবোট, ট্রলার চলাচল বন্ধ রাখার জন্য বলেছে।
ভোলার ইলিশা ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ পারভেজ খান বলেন, গতকাল রাত থেকেই তারা ভোলার ইলিশা-লক্ষ্মীপুরের মজু চৌধুরীর হাট ও ভোলার ভেদুরিয়া-বরিশালের লাহারহাট নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।

ভোলা নদীবন্দর সূত্র আরও জানায়, শনিবার রাত থেকে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে বাতাসের গতি ও নদীতে ঢেউ বেড়ে যাওয়ায় ভোলা-ঢাকা, ইলিশা-ঢাকা, ভোলা-বরিশাল, চরফ্যাশন–ঢাকা, লালমোহন–ঢাকা, বোরহানউদ্দিন–ঢাকা, হাতিয়া–মনপুরা–ঢাকা, ইলিশা-মেহেন্দীগঞ্জ, ভেদুরিয়া–কালাইয়া, নাজিরপুর–কালাইয়া–ধুলিয়া, কচ্ছপিয়া–কুকরি মুকরি, কচ্ছপিয়া–ঢালচার, চরফ্যাশন–বেতুয়া, তজুমদ্দিন–মনপুরা, তজুমদ্দিন–চরমন্তাজ, তজুমদ্দিন–কলাতলী, কলাতলী–মনপুরা, দক্ষিণ সাকুচিয়া–চরনিজাম, হাকিমুদ্দিন–আলেকজান্ডার, দৌলতখান–আলেকজান্ডার, চৌকিঘাটা–মতির হাট,   নাসির মাঝি–মদনপুর, তুলাতুলি–মতির হাটসহ ভোলার একাধিক নৌপথে লঞ্চ, ফেরি, সি–ট্রাক, স্পিডবোট ও যাত্রীবাহী ট্রলার চলাচল বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

চরফ্যাশনের দক্ষিণে ঢালচর ইউনিয়নের শাহ আলম ফরাজী বলেন, শনিবার রাত থেকে ঢালচর, চর পাতিলা, চর নিজাম, কুকরি–মুকরিসহ সাগর মোহনায় দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে, সঙ্গে ছিল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি।

ভোলার দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফারুক দৌলত বলেন, চরে ১০টি বাথানে প্রায় ১০ হাজার মহিষ রয়েছে। ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে প্রায় আড়াই হাজার পরিবারে আরও ২৫ হাজার গবাদিপশু আছে। গবাদিপশুর মালিক ও বাথানিদের মুজিব কিল্লাসহ বিভিন্ন নিরাপদ আশ্রয়ে গবাদিপশু নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ঘরবাড়িতে থাকা মানুষজনকে ইউনিয়নের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আসতে বলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে পর্যাপ্ত শুকনা খাবার ও নিরাপদ পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

ভোলা জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান বলেন, শনিবার রাতে তাঁরা জরুরি সভা করেছেন। সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ৬ থেকে ৭ হাজার মানুষ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন। আরও  মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আনার চেষ্টা চলছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে উপকূলীয় এলাকাগুলোর পর ঢাকার দোহার উপজেলার মৈনটঘাট থেকে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।
আজ দুপুরে মৈনটঘাটে গিয়ে দেখা যায়, পদ্মা নদীতে উত্তাল ঢেউ। ঘাটে কোনো যাত্রী নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের দোকানপাট ও খাবারের হোটেলগুলো বন্ধ করে রেখেছেন।

বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তা নেওয়াজ মাহমুদ খান বলেন, মাওয়াসহ মৈনটঘাটের এপার ও ওপারে নদীতীরবর্তী এলাকায় ছোট–বড় নৌকা, বিভিন্ন ধরনের নৌযান নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

দোহার মৈনটঘাটের ঘাটমালিক আবুল কাসেম বলেন, ‘আমরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী ঘাটের সব ধরনের কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। বিভিন্ন ধরনের নৌযান, লঞ্চ নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, ভোলা, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা ও সংবাদদাতা, নবাবগঞ্জ, ঢাকা)