কচুরিপানায় বেহাল ভৈরব নদ

নদটিকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র আশা ছিল পুনঃখনন এবং বারবার তদারকি। তা পাঁচ বছর ধরে না করায় কচুরিপানা দখল করেছে ২৯ কিলোমিটার অংশ। 

একসময়ের খরস্রোতা ভৈরব নদ এখন মরা খালের মতো। কচুরিপানায় ভরে থাকছে। কচুরিপানা সরানোর কোনো উদ্যোগ নেই। গত বুধবার মেহেরপুর সদরের কুলবাড়িয়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

মেহেরপুরের ভৈরব নদ খননের পাঁচ বছরের মাথায় আবারও কচুরিপানায় ভরে গেছে। তদারকির অভাবে কচুরিপানার জঞ্জালে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে নদটির বেহাল। হুমকিতে পড়েছে জলজ জীববৈচিত্র্য। মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় জেলেদের জীবন-জীবিকাও শঙ্কায় পড়েছে।

এলাকাবাসী বলছেন, সরকার ভৈরব নদ পুনঃখনন করে নদের জীবন বাঁচিয়েছিল। নদের ভারতীয় অংশ থেকে বাংলাদেশের অংশে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় স্রোতহারা নদে পরিণত হয়েছে ভৈরব। এরপরও নদটিকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র আশা ছিল পুনঃখনন এবং বারবার তদারকি। তা পাঁচ বছর ধরে না করায় কচুরিপানা দখল করেছে ২৯ কিলোমিটার নদের অংশ। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নদটি মরা খালে পরিণত হবে।

ভারতে গঙ্গার শাখানদী জলাঙ্গি থেকে ভৈরবের উৎপত্তি। ভারত থেকে মেহেরপুর সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের শোলমারি গ্রাম দিয়ে ভৈরব নদ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর মুজিবনগর উপজেলার রসিকপুর দিয়ে নদটি পাশের ঝিনাইদহ জেলায় ঢুকেছে। এরপর যশোর হয়ে খুলনার রূপসা নদীতে পড়ে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে পশুর নদ নাম নিয়ে সাগরে মিশেছে। ‘ভৈরব’ অর্থ ভয়াবহ। একসময় পদ্মা (গঙ্গা) নদীর মূল প্রবাহ এ নদকে প্রমত্ত রূপ দিয়েছিল, সেই থেকেই নামটির উৎপত্তি। এ থেকেই আন্দাজ করা যায় ভৈরবে আগে কতটা স্রোত ছিল।

গত শনিবার সরেজমিনে নদের কাথুলী, গাড়াবাড়িয়া, সহগলপুর, কুলবাড়িয়া, কালাচান্দপুর, দারিয়াপুর অংশে দেখা গেছে, নদের বেশির ভাগ অংশের পানি ঢেকে আছে কচুরিপানায়। সামান্য কিছু অংশ এলাকার মানুষ গোসল করার জন্য পরিষ্কার করেছে। সেখানে স্বচ্ছ পানি দেখা গেছে। স্থানীয় কয়েকজন মাথার ওপরে ছাতা ধরে কচুরিপানা সরিয়ে ছিপ ফেলে বসে রয়েছেন।

সদর উপজেলার কালাচান্দপুর গ্রামের অশীতিপর আলহামদু মিয়া, রহমান শেখ, মছের আলী বলেন, একসময় নদে অনেক স্রোত ছিল। দেশভাগের (১৯৪৭ সাল) আগে ভৈরব নদে জাহাজ চলত। খুলনা, যশোর, মেহেরপুর হয়ে কলকাতায় যেত পণ্যবাহী জাহাজ। সেসব এখন অতীত। ২০১৭ সালে সরকার ভৈরব নদ খনন করলে এলাকার মানুষের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু অযত্ন-অবহেলায় নদে কচুরিপানা ভরে গেছে। অনেকে ময়লা ফেলেন কচুরিপানার ওপরে। এতে কচুরিপানা পচে দুর্গন্ধ বের হয়।

কুতুবপুর ইউনিয়নের উজলপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে ভৈরব বয়ে গেছে। ওই গ্রামের বাসিন্দা আয়েশা খাতুন বলেন, নদ খননে লাভ হয়েছিল। সেচের সুবিধা বেড়েছিল। খননের পরে স্বচ্ছ পানিতে এলাকার অনেকে গোসল করত। ছেলেমেয়েরা গোসল করতে গিয়ে জাল দিয়ে ছোট ছোট মাছ ধরে আনত। এখন কচুরিপানার কারণে কেউ নদে গোসল করতে নামে না। ছোট মাছ ছাড়া অন্য মাছ এই কচুরিপানায় পাওয়া যায় না বলে মাছ ধরা কমে গেছে।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের অনুষ্ঠানে ভৈরব নদ খননের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল শুরু হয় খননকাজ। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে তা শেষ হয়। গাংনী উপজেলার কাথুলী থেকে মুজিবনগর উপজেলার রতনপুর পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার খনন করা হয়। নদের তলদেশে খননের পাশাপাশি মাটি দিয়ে দুই পাড় ৬২-৭০ মিটার চওড়া করে বাঁধাই করার কথা ছিল। নদের গভীরতা হওয়ার কথা ছিল পাড় থেকে ৩৫ ফুট।

এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন, যথেষ্ট গভীর না করেই খনন করা হয়েছে। খননের সময় নদের দুই পাড়ে ঢিবি করে মাটি উঁচু করে গভীরতা ৩৫ ফুট দেখানো হয়।

খননের সুফল না পাওয়ার ব্যাপারে জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাহিনুজ্জামান বলেন, ভৈরব তার সৌন্দর্য হারিয়েছে কচুরিপানার জন্য। সম্প্রতি দেশে কচুরিপানা অপসারণে জন্য একটি যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। পাউবোর প্রধান কার্যালয়ে আবেদন করা হয়েছে ওই যন্ত্রের জন্য। সরকার নতুন করে আবারও ভৈরবের বাকি ৩০ কিলোমিটার খননের উদ্যোগ নিয়েছে। ওই সময় কচুরিপানা সরিয়ে ফেলা হবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শঙ্কর কুমার মজুমদার বলেন, ভৈরব নদের পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করা গেলে কৃষকদের অনেক উপকার হতো। নদের নাব্যতাসংকটের কারণে এসব অঞ্চলের কৃষকেরা ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করেন। এতে খরচের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। নদের পানি এতটাই নিচে নেমেছে যে, পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই।

জেলা নদী বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম বলেন, ১৬০ কিলোমিটার ভৈরবের অনেক স্থান দখল-দূষণ ও কচুরিপানায় ভরে গেছে। ৮০ শতাংশই প্রায় স্রোতহীন, প্রাণহীন। ভৈরবের ওপর বাঁধ, কালভার্ট, সেতু হয়েছে। দুই পাড় দখল হয়েছে। শুষ্ক ভৈরবের মাঝখানে ধান চাষ হচ্ছে।