টানা দুই বছর হোঁচট খেল কনটেইনার পরিবহন

চট্টগ্রাম বন্দরফাইল ছবি

কনটেইনার পরিবহনে আবারও হোঁচট খেল দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম। বিদায়ী বছরে বন্দর দিয়ে আগের বছরের তুলনায় কনটেইনার পরিবহনের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৩ শতাংশ। এ নিয়ে টানা দুইবার কমল কনটেইনার পরিবহন।

শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতি, বাণিজ্যিক পণ্য—সবই আনা হয় কনটেইনারে। আবার সমুদ্রপথে রপ্তানি পণ্যের প্রায় পুরোটাই কনটেইনারে পাঠানো হয়। দেশের মোট কনটেইনারের ৯৮ শতাংশ পরিবহন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। ফলে এই বন্দরের কনটেইনারের সংখ্যার হিসাব দিয়ে দেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির ধারণা পাওয়া যায়।

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী বছরে বন্দর দিয়ে কনটেইনার (প্রতিটি ২০ ফুট লম্বা) পরিবহন হয়েছে ৩০ লাখ ৫০ হাজার। ২০২২ সালে পরিবহন হয় ৩১ লাখ ৩২ হাজার। সংখ্যার হিসাবে কমেছে প্রায় ৯১ হাজার কনটেইনার। বন্দরের মূল জেটি, ঢাকার কমলাপুর কনটেইনার ডিপো ও কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনালে কনটেইনার পরিবহনের সংখ্যা যোগ করে এই হিসাব দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এই তালিকায় আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী ও খালি কনটেইনার হিসাব করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, বৈশ্বিক সংকটের প্রভাবে সমুদ্রপথের বাণিজ্য কমেছে। তাতে কনটেইনারজাত পণ্য পরিবহন কমেছে। আবার অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক পদক্ষেপ নিয়েছে। এ কারণে কনটেইনারে পণ্য আমদানিও কিছুটা কমেছে। তবে পণ্য পরিবহন কমলেও বন্দরের সেবার মান বেড়েছে। পণ্য হাতে পেতে দেরি হচ্ছে না।

বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে কনটেইনার পরিবহনে প্রথম হোঁচট আসে করোনার সময়। করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপথের বাণিজ্যে অচলাবস্থা তৈরি হয়। উৎপাদন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাতে ২০২০ সালে কনটেইনার পরিবহনও ২ শতাংশ কমে যায়। করোনা কাটিয়ে ওঠার পর ২০২১ সালে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে আমদানি-রপ্তানি খাত।

তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলার-সংকটে পণ্য আমদানি কমতে থাকে ২০২২ সালে। আর বিদায়ী বছরে ডলার-সংকট থেকে বের হওয়া যায়নি। বরং আমদানি নিয়ন্ত্রণে আরও কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসবের প্রভাবে বিদায়ী বছরেও ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি থেকে বের হতে পারেনি বন্দর।

কনটেইনারের সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারী হলো তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা। সমুদ্রপথে পোশাকের কাঁচামালের পুরোটাই আনা হয় কনটেইনারে। রপ্তানিও পুরোটা পাঠানো হয় কনটেইনারে। ফলে এই খাতের প্রবৃদ্ধির ওপর কনটেইনারের পরিবহন বাড়বে না কমবে, তা নির্ভর করে।

জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্পের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিদায়ী বছরে নানা সমস্যার মধ্যে গেছে পোশাকশিল্প। তারই প্রতিফলন ঘটেছে কনটেইনার পরিবহনে। আবার ইউরোপে এখনো মন্দা চলছে। পোশাকের চাহিদা কম। উল্টো দিকে দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় পোশাক খাতে খরচ বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে গ্যাস-বিদ্যুৎ খরচ কমিয়ে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সুযোগ আছে। সে জন্য গ্যাস-বিদ্যুতের দাম কমানো উচিত। না হলে পোশাকে সুখবর আসবে না। বন্দরেও কনটেইনার পরিবহন বাড়বে না।

কনটেইনার পরিবহন এমন সময়ে কমছে, যখন জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর নতুন নতুন সুবিধা যুক্ত হচ্ছে। গত ডিসেম্বরে নবনির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল সৌদি কোম্পানি রেড সি গেটওয়ে লিমিটেড ইন্টারন্যাশনালকে যন্ত্রপাতি বিনিয়োগ ও পরিচালনার জন্য দেওয়া হয়েছে। দুই-তিন মাসের মধ্যে এই টার্মিনালটি চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এই টার্মিনালে একসঙ্গে তিনটি জাহাজ ভেড়ানো যাবে।  

কনটেইনার পরিবহন কমায় বৈশ্বিক তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান আরও পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ২০২২ সালে কনটেইনার পরিবহন কমে যাওয়ায় তিন ধাপ পিছিয়ে ৬৭তম অবস্থানে চলে যায় চট্টগ্রাম বন্দর, যেটি গত বছর প্রকাশ করে লন্ডনভিত্তিক পুরোনো সংবাদমাধ্যম লয়েডস লিস্ট। ২০২৩ সালের কনটেইনার পরিবহনের সংখ্যা হিসাব করে এ বছরের মাঝামাঝি বৈশ্বিক ক্রমতালিকা প্রকাশ করবে সংস্থাটি। তাতে যে সুসংবাদ থাকবে না, তা কনটেইনার পরিবহনের সংখ্যা কমার চিত্র তুলে ধরেছে।