নৌ পুলিশের চাঁদাবাজিতে জেলেরা পেশা বদলাচ্ছেন 

নৌ পুলিশকে চাঁদা না দিলে নদীতে মাছ ধরা যায় না। টাকা না পেলে জাল ও নৌকা জব্দ করে নিয়ে যায় পুলিশ।

ফাইল ছবি

জেলে দেলোয়ার হোসেন (৪৫) পদ্মা নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতেন। কিন্তু নৌ পুলিশের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি নৌকা ও জাল বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন পেশা পাল্টে তিনি অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করেন। দেলোয়ারের ভাষ্য, জাল ও নৌকা নিয়ে নদীতে নামলেই নৌ পুলিশ আটক করে চাঁদা দাবি করে। টাকা না দিলে জাল নিয়ে চলে যায়। বাধ্য হয়ে তিনি জাল ও নৌকা বিক্রি করে পেশা পাল্টেছেন।

দেলোয়ারের বাড়ি মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার পদ্মা নদীর তীরবর্তী নয়াকান্দি গ্রামে। গ্রামটির অন্তত ৬০টি পরিবার নদীতে মাছ ধরে সংসার চালায়। তাদের বেশির ভাগই আগে কৃষিকাজ করতেন। নদীভাঙন ও সরকারি প্রকল্পের কারণে কৃষিজমি হারিয়ে তাঁরা নদীতে মাছ ধরতেন। কিন্তু নৌ পুলিশের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁরা নদীতে নামতে পারছেন না। জেলেদের অভিযোগ, নদীতে মাছ ধরতে নামলেই তাঁদের পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। অন্যথায় তাঁদের জাল ও নৌকা জব্দ করে নৌ পুলিশ।

জেলেদের এমন অভিযোগের কথা আমিও শুনেছি। আমি আমার ফাঁড়ির সদস্যদের ওই সব কাজ করতে সম্পূর্ণ নিষেধ করেছি। দৌলতদিয়া ফাঁড়ির সদস্যদেরও এপারে আসতে মানা করেছি। এতে আমাদের বদনাম হচ্ছে।  
মিজানুর রহমান, ইনচার্জ (পরিদর্শক), পাটুরিয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ি 

জেলেদের অভিযোগের বিষয়ে পাটুরিয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ি পদ্মার ওপারে দৌলতদিয়া ও কাজিরহাট ফাঁড়ির সদস্যদের দুষছে। তাদের দাবি, ওপারের কেউ কেউ এপারে এসে তাদের বদনাম করে। পাটুরিয়া ফাঁড়ির পক্ষ থেকে তাঁদের এপারে আসতে নিষেধ করা হয়েছে।

নয়াকান্দি গ্রামের অন্তত ১২ জন জেলে অভিযোগ করেন, নৌ পুলিশকে চাঁদা না দিলে নদীতে মাছ ধরা যায় না। টাকা না দিলে নৌকা ও জাল নিয়ে যায়। এমনকি মামলা ও সাজা দেওয়া হয়। নৌ পুলিশের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁরা পেশা বদলানোর কথা ভাবছেন। ইতিমধ্যে কেউ কেউ অন্য পেশায় ঝুঁকেছেন। স্থানীয় পাটুরিয়া নৌ থানার পুলিশ ও রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফাঁড়ির সদস্যরা চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত।

স্থানীয় সূত্র জানায়, নয়াকান্দি গ্রামের জেলেরা এক সময় কৃষিকাজ করতেন। নদীভাঙনে অনেকে জমি ও ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। এ ছাড়া সাত বছর আগে গ্রামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় অনেকের জমি অধিগ্রহণ করা হয়। কারও কারও কিছু কৃষিজমি থাকলেও চাষাবাদের আয়ে সংসার চলে না। এ জন্য নদীতে জাল বেয়ে বেলে, লাঠি, নোয়াগারা, খসল্লা, চাপিলা, টাটকিনিসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরেন তাঁরা। এ থেকে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় হয়। এমন পরিস্থিতিতে নৌ পুলিশের চাঁদাবাজির কারণে তাঁরা আরও বিপাকে পড়েছেন। জেলেরা চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানান।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে নয়াকান্দি গ্রামঘেঁষা পদ্মাপাড়ে সারি সারি নৌকা বাঁধা দেখা যায়। পাশেই গ্রামের নারী ও পুরুষ নদীতে গোসল করছিলেন। নদীর পাড়ে ওঠানো নৌকায় বসে ছিলেন জেলে আবুল কাশেম (৬০)। তিনি বলেন, ‘নৌকা-জাল নিয়ে নদীতে গেলে পুলিশ দাবড়ায়। হেই জন্যি জাল বাওয়া বাদ দিয়্যা বইসা রইছি। পুলিশরে ট্যাহা দিতে পারি না দেইখ্যা জাল বাওয়া বাদ দিছি।’

চাঁদা নিতে নৌ পুলিশ সারা দিন মুখিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ করেন গ্রামের বাসিন্দা মো. নেওয়াজ। এক জেলের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে নেওয়াজ বলেন, ‘তিন দিন আগে (সোমবার) গ্রামের রজ্জবের জাল নিয়ে গেছিল। জাল আনার জন্য চার হাজার ট্যাকা চাইছিল। পরে দুই হাজার ট্যাকা দিয়া রজ্জব জাল আনছে।’

নৌকা-জাল নিয়ে নদীতে গেলে পুলিশ দাবড়ায়। পুলিশরে ট্যাহা দিতে পারি না দেইখ্যা জাল বাওয়া বাদ দিছি। 
আবুল কাশেম, জেলে 

জেলে আবদুল মালেকের (৫০) ভাষ্য, ‘আমরা নদীতে বাইল্যা মাছ ধরি। বোট নিয়্যা পুলিশ আইস্যা আমাদের জাল নিয়্যা যায়। আর ৫০০ থেকে ১ হাজার ট্যাকা দিলেই ছাইড়্যা দেয়। আমরা তো অবৈধভাবে জাটকা মারতাছি না!’ তিনি বলেন, যাঁরা জাটকা ধরেন, পুলিশ তাঁদের কিছু বলে না। সাধারণ জেলেদের জাল ও নৌকা জব্দ করে পুলিশ।

পাটুরিয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জেলেদের এমন অভিযোগের কথা তিনিও শুনেছেন। সেখানে (নয়াকান্দি) দৌলতদিয়া ও কাজিরহাট ফাঁড়ির পুলিশও আসে। তিনি তাঁর ফাঁড়ির সদস্যদের ওই সব কাজ করতে সম্পূর্ণ নিষেধ করেছেন। দৌলতদিয়া ফাঁড়ির সদস্যদেরও এপারে আসতে মানা করেছেন। কারণ, এপার তাঁদের অধীন। এতে তাঁদের বদনাম হচ্ছে।

শিবালয় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, জেলেদের কাছে চাঁদাবাজির বিষয়টি জানার পরপরই তিনি পাটুরিয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির কর্মকর্তাদের ফোন দিয়ে অভিযোগের কথা বলেছেন। চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে নৌ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হবে।