ভয়ে অনেকে এলাকাছাড়া

ভোটের পর প্রায় প্রতিদিনই হামলা-লুটপাট চলছে। নির্বাচন ঘিরে দুই উপজেলায় ১৫টি মামলায় উভয় পক্ষের ১৪২ জনকে আসামি করা হয়েছে।

বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের উত্তর উলানিয়া এলাকার মাছঘাটের নিরাপত্তায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবারছবি: প্রথম আলো

বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ) আসনে ভোটের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই প্রতিপক্ষের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। এ আসনের নির্বাচনী এলাকার দুই উপজেলায় গত এক মাসে ছোট–বড় মিলিয়ে অন্তত ৫০টি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। সব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা মামলা না করলেও দুই থানায় অন্তত ১৫টি মামলা রেকর্ড হয়েছে। মামলায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের ১৪২ জনকে আসামি করা হয়েছে। হামলার আশঙ্কায় জনপ্রতিনিধিসহ অনেকে এখনো এলাকায় ফিরতে পারছেন না।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে সংসদ সদস্য পংকজ নাথের সমর্থকেরা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করছেন। তবে পংকজ নাথ বলছেন, হামলা-সংঘাতের সঙ্গে রাজনীতি বা নির্বাচনের সম্পর্ক নেই। সবই নাটক।

বরিশাল-৪ আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান দলের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ। কিন্তু দ্বৈত নাগরিকত্বের জটিলতায় শাম্মী আহমেদের মনোনয়ন বাতিল হয়ে যায়। দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আবার সংসদ সদস্য হয়েছেন পংকজ নাথ।

স্থানীয় সূত্র জানায়, পংকজ নাথ মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর তাঁর অনুসারী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা শুরুর দিকে এলাকায় কোণঠাসা হয়ে পড়েন। শাম্মী আহমেদের অনুসারী নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে অনেকে এলাকা ছাড়েন। শাম্মী আহমেদের মনোনয়ন স্থগিত হয়ে গেলে পংকজের অনুসারী নেতা-কর্মীরা আবার এলাকায় ফেরেন। ৭ জানুয়ারি ভোটে পংকজ নাথ জয়ী হলে প্রতিপক্ষের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা শুরু হয়। এরপর শাম্মীর অনুসারী নেতা-কর্মীদের অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে যান।

হামলা-লুটপাট থামছেই না

সবশেষ ৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় হিজলা-গৌরাব্দি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের ছয় নেতা-কর্মীকে কুপিয়ে জখম করা হয়। এ সময় স্থানীয় এক ইউপি সদস্যের দোকান ভাঙচুর করা হয়। একই দিন নৌকার দুজন কর্মীর মুদিদোকানে হামলা ও লুটপাট করা হয়। হিজলার ধুলখোলা ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামে হামলা করে চারজনকে আহত করা হয়। ২৫ জানুয়ারি মেহেন্দীগঞ্জ পৌরসভার চরহোগলায় বাসায় ঢুকে পংকজের বিরোধী পক্ষের এক কর্মীকে পেটানো হয়। ১৯ জানুয়ারি মেহেন্দীগঞ্জের দক্ষিণ উলানিয়া ইউনিয়নে মেঘনা নদীতে হামলা করে দুজনকে মারধরের পর তাঁর নৌকা ও জাল কেড়ে নেওয়া হয়। ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কর্মী উজ্জ্বল সিকদারের ড্রেজার লুট করা হয়। ১০ জানুয়ারি চানপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের তিন কর্মীকে পেটানো হয়। ৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় একই ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতাকে পিটিয়ে তাঁর মুদিদোকানে লুটপাট চালানো হয়।

হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের পর দুই উপজেলায় অসংখ্য হামলার ঘটনা ঘটেছে। জমি দখল, মারধর, লুটপাটসহ নানা ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আতঙ্কিত। অনেকে ভয়ে অভিযোগ পর্যন্ত করেননি। অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।

১৫ মামলায় আসামি ১৪২

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার অনেক ঘটনা ঘটলেও সব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা মামলা করেননি। ২ জানুয়ারি থেকে গত রোববার পর্যন্ত দুই থানায় ১৫টি মামলা হয়েছে। ১৫ মামলার ১৪টিরই বাদী শাম্মী আহমেদের সমর্থকেরা। এর মধ্যে হিজলায় ১০টি মামলায় এজাহারনামীয় আসামি ৯২ জন। মেহেন্দীগঞ্জের পাঁচটি মামলায় আসামি ৫০ জন। এ ছাড়া প্রতিটি মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি আছেন। সব মিলিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন মাত্র ২৪ জন।

 

অনেকেই এলাকাছাড়া

শাম্মীর প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার পর ২ জানুয়ারি এলাকা ছাড়েন হিজলার ধুলখোলা ইউপির চেয়ারম্যান জামাল উদ্দীন ঢালি। জামাল উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকায় কীভাবে যাব, মানসম্মান তো বাঁচবে না। আমার লিজ নেওয়া আলীগঞ্জ লঞ্চঘাট দখল করে নিয়েছে, চারটি দোকান লুট করেছে, তিনটি মাছঘাট দখল হয়েছে। আমার এলাকার ৩০-৪০ জনকে জখম করেছে। আটটি মাছ ধরার ট্রলার আটকে ৩০-৪০ হাজার টাকা করে চাঁদা নিয়েছে। আওয়ামী লীগ করেও এতটা অসহায় হয়ে পড়েছি যে জনপ্রতিনিধি হয়েও এলাকায় যেতে পারছি না।’

উত্তর উলানিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আরেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জীবনের ভয়ে এলাকা ছেড়েছি। জানি না কবে এলাকায় ফিরতে পারব।’

‘নির্বাচন নয়, স্বার্থের দ্বন্দ্বে সংঘাত হচ্ছে’

সহিংসতার এসব ঘটনাকে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বলছেন পংকজ নাথের অনুসারীরা। পংকজের অনুসারী মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য সুভাষ চন্দ্র সরকার বলেন, সংসদ সদস্য পংকজ নাথ মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর তাঁর সমর্থকেরাও নানাভাবে অপদস্থ হয়েছিলেন। পরে অবশ্য প্রেক্ষাপট পাল্টে যায়। তবে সংসদ সদস্য সমর্থকদের শান্ত থাকতে বলেছেন। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এখন যেগুলো ঘটছে, সেগুলো স্বার্থের দ্বন্দ্ব, অন্য কিছু নয়।

হামলা-সংঘাতের ঘটনা নির্বাচনকেন্দ্রিক নয় বলে দাবি করেন সংসদ সদস্য পংকজ নাথ। তিনি বলেন, হিজলা-গৌরাব্দি ইউপির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ২৪টি মাছঘাট বসিয়ে মেঘনা নদীর তীর নিয়ন্ত্রণ করছেন। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও চরের মাটি কেটে বিক্রি করছেন। ওই কাজে বাধা দেওয়ায় রাজনৈতিক রং দিয়ে ভিন্ন দিকে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। সবই নাটক। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ব্যবসা করি। ব্যবসা করা কি অপরাধ? নির্বাচনের পর প্রতিদিনই হামলা-দখল, লুটপাট চলছে। হামলা-সংঘাতের মধ্যে ব্যবসা টেনে এনে ঘটনা আড়াল করা হচ্ছে।’