১৯ ধরনের চা বেচেন আলী হোসেন, চাহিদার শীর্ষে ১১ উপকরণে তৈরি ‘বুলেট চা’
সিলেট নগরের রিকাবিবাজার এলাকায় কবি নজরুল অডিটোরিয়ামের ঠিক সামনের সড়কেই আলী হোসেনের ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকান। প্রতিদিন অন্তত ৫০০ কাপ চা বিক্রি করেন তিনি। ছুটির দিনে তা বেড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ কাপে দাঁড়ায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলী হোসেনের চায়ের দোকানে ১৯ ধরনের চা মেলে। এর একটি ‘বুলেট চা’। মূলত, তাঁর দোকানে এমন চায়ের কদরই ক্রেতাদের কাছে বেশি। প্রতিদিন গড়ে শতাধিক কাপ বুলেট চা বিক্রি করে থাকেন। আকর্ষণীয় ও সুস্বাদু রেসিপির কারণেই বুলেট চায়ের কদর খুব বেশি।
আলী হোসেন জানান, তেঁতুল, কাঁচা মরিচ, আদা, কালিজিরা, পুদিনাপাতা, বিটলবণ, গরমমসলা, লেবুসহ ১১ রকমের উপকরণ দিয়ে বুলেট চা প্রস্তুত করা হয়। প্রতি কাপ চায়ের দাম ২০ টাকা। আলী হোসেনের দোকানে এমন চা এতই বেশি বিক্রি হয়ে থাকে, যে কারণে ৩২ বছর বয়সী আলীকে এখন অনেকে ‘বুলেট’ নামেই ডাকেন, চেনেন।
সংসার টাইনাটুইনা চালাইতে হয়। টেকার কুনু মূল্য নাই। সামনে যে কী দিন আইতাছে, জানি না!
গতকাল বুধবার দিবাগত রাত পৌনে ১২টার দিকে দেখা গেছে, আলী হোসেনের দোকান ঘিরে ক্রেতাদের ভিড়। সড়কের এক পাশে দাঁড়িয়ে কাপে চুমুক দিতে দিতে মানুষ চা পানের সঙ্গে গল্পগুজবে মশগুল। বিরামহীনভাবে আলী হোসেন চা প্রস্তুত করে ক্রেতাদের হাতে একের পর এক তুলে দিচ্ছেন। প্রতি কাপ চায়ের দাম ১০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০ টাকা পর্যন্ত রয়েছে।
প্রচণ্ড শীতের মধ্যে শুধু একটি টি-শার্ট শরীরে জড়িয়ে আলী হোসেন চা প্রস্তুত করছিলেন। কাজ করতে করতেই তিনি প্রথম আলোর এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, তাঁর দোকানের ১৯ ধরনের চায়ের মধ্যে বুলেট চা ছাড়াও মালাই চা, কাঠবাদাম চা, কাজু চা ও মালটা চায়ের বেশ কদর আছে। খরচ বাদে প্রতিদিন গড়ে তাঁর ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয়। তবে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় এ টাকা দিয়ে সংসার চালাতে তাঁকে হিমশিম খেতে হয়। এ কারণে কোনোরকমে তিনি বেঁচেবর্তে আছেন।
আলী হোসেনের বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলায়। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা একেবারেই করেননি। ২০০৮ সালে তিনি নানা মোবারক হোসেনের সঙ্গে সিলেট শহরে প্রথম আসেন। এরপর এ শহরেই থিতু হয়েছেন। ১০ বছর নানার দোকানে কাজ করেন। এরপর দুই বছর আগে নিজেই ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকান চালু করেন। প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখেন। তাঁর ছোট ভাই দোকান পরিচালনার কাজে তাঁকে সহযোগিতা করেন।
গল্পে গল্পে আলী হোসেন জানান, গ্রামের বাড়িতে মা–বাবা ছাড়াও ভাইবোনেরা আছেন। পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। এরই মধ্যে দুই বোনের বিয়ে দিয়েছেন। সিলেট নগরের মদিনা মার্কেট এলাকায় আড়াই হাজার টাকা দিয়ে একটি বাসা ভাড়া নিয়েছেন। এখানে স্ত্রী, ভাই ও সাড়ে চার বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে থাকেন। সীমিত আয় হওয়ায় তাঁকে অনেক কৃচ্ছ্রতা করে চলতে হয়। এর মধ্যে গ্রামের বাড়িতেও তাঁকে নিয়মিত পরিবারের সদস্যদের জন্য কিছু টাকা পাঠাতে হয়।
চা তৈরির উপকরণের দাম ক্রমাগত বাড়ছে জানিয়ে আলী হোসেন বলেন, কিছুদিন আগে প্রতি কেজি গুড় ১০০ টাকা ছিল, এখন তা ৫০ টাকা বেড়েছে। প্রতি কেজি চিনির দাম যেখানে ছিল ৭০ টাকা, এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২০ টাকায়। এ কারণে প্রতি কাপ চায়ের দাম তিনি ৩ টাকা বাড়িয়েছেন। এরপরও আগের মতো মুনাফা হয় না। লাভ কমেছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আঁচ লেগেছে আলী হোসেনের সংসারেও। তিনি বলেন, ‘ঘরভাড়ার পাশাপাশি কারেন্ট বিল মাসে দিতে হয় ৫০০ টাকা। খাওয়া বাবদ খরচ যায় আরও আট থাকি নয় হাজার টাকার মতন। সংসার টাইনাটুইনা চালাইতে হয়। টেকার কুনু মূল্য নাই। সামনে যে কী দিন আইতাছে, জানি না!’
পড়াশোনা করতে না পারায় আক্ষেপ আলী হোসেনের মনে। তিনি বলেন, ‘পড়াশোনা করলে ভালা চাকরিবাকরি করতাম। তাইলে কি আর চায়ের দোকান চালাইতাম?’