অসহায় বিচারপ্রার্থীদের আস্থা লিগ্যাল এইড 

লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে বিচারপ্রার্থী হিসেবে যাঁরা আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই নারী ও দরিদ্র পরিবারের। 

মাগুরা সদর উপজেলার পারনান্দুয়ালী এলাকার রিজিয়া বেগমের সঙ্গে সোলই গ্রামের মো. মিলন মোল্যার বিয়ে হয়েছিল ২০২২ সালে। তবে কয়েক মাস যেতে না যেতেই দুজনের মধ্যে নানা বিরোধ শুরু হয়। একপর্যায়ে দুজন আলাদা হয়ে যান। তবে রিজিয়া দেনমোহর ও খোরপোশের টাকা পাচ্ছিলেন না। আদালতে মামলা চালানোর মতো আর্থিক সংগতিও ছিল না তাঁর।

এমন পরিস্থিতিতে পরিচিত লোকজনের পরামর্শে মাগুরা জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ের শরণাপন্ন হন রিজিয়া। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে কার্যালয়ে আবেদন করেন তিনি। আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান পান রিজিয়া। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর-অলটারনেটিভ ডিসপিউট রেজল্যুশন) মাধ্যমে দেনমোহরের ৭৫ হাজার টাকা এবং খোরপোশ বাবদ ১৫ হাজার টাকা বুঝে পান এই নারী। এর পাশাপাশি সাবেক স্বামীর বাড়িতে থাকা অন্য মালামালও ফেরত পান তিনি।

শুধু রিজিয়া নন, তাঁর মতো অসংখ্য অসহায় বিচারপ্রার্থীর ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে মাগুরা জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়। এই কার্যালয়ের মাধ্যমে আপস-মীমাংসার পাশাপাশি অসহায়–অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীরা সরকারি খরচে মামলা চালানোরও সুযোগ পাচ্ছেন।

আজ ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘স্মার্ট লিগ্যাল এইড, স্মার্ট দেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। দিবস উপলক্ষে আজ রোববার মাগুরা জেলা ও দায়রা জজ আদালত চত্বরে আইনগত সহায়তা উদ্বুদ্ধকরণ শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি আয়োজন করা হয়েছে।

জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা (সিনিয়র সহকারী জজ) মো. ফরিদুজ্জামান বলেন, লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে বিচারপ্রার্থী হিসেবে যাঁরা আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই নারী। বেশির ভাগ অভিযোগ আসে পারিবারিক বিরোধ, যৌতুক, খোরপোশ, অভিভাবকত্ব বিষয়ে। এর পাশাপাশি বাল্যবিবাহ, জমিজমাসংক্রান্তসহ নানা রকম অভিযোগ নিয়েও আসেন বিচারপ্রার্থীরা। এখানে এমন সব বিষয় নিয়ে মানুষ আসেন, যে সমস্যাগুলো নিয়ে মানুষ মামলায় করতে চান না। আবার এখানে এমন মানুষও আসেন, যাঁদের আদালতে মামলা চালানোর সক্ষমতা নেই। অসচ্ছল, অসহায় এসব মানুষকে সরকারি খরচে মামলা চালাতে সহযোগিতা করে লিগ্যাল এইড কার্যালয়।

জেলা লিগ্যাল এইডের গত তিন বছরের কার্যক্রমের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিচারপ্রার্থীদের আবেদনের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি কার্যালয়ের সেবাও বাড়ছে। মাগুরা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে ২০২১ সালে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) আবেদন জমা পড়েছিল ২৬৮টি। পরের বছর এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০৬–এ। আর ২০২৩ সালে আবেদন জমা পড়ে ৩৯৯টি। গত ৩ বছরে জমা পড়া ৯৭৩টি এডিআরের মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ৯০৩টি অভিযোগ। এর মধ্যে ২৪৩টি ঘটনায় বিরোধ নিষ্পত্তি সফল হয়েছে। এসব অভিযোগের মধ্যে বিবদমান পক্ষগুলোর আপসে জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রায় ৭৫ লাখ টাকা আদায় করে দেওয়া হয়।

২০২৩ সালে মাগুরা সদর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালতে যৌতুক নিরোধ আইনে একটি মামলা করেন আয়েশা খাতুন নামের এক গৃহবধূ। সদর উপজেলার জাগলা গ্রামের কৃষক বাবার মেয়ে আয়েশা ছিলেন আর্থিকভাবে অসচ্ছল। স্থানীয় বাসিন্দাদের পরামর্শে লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে সরকারি খরচে মামলা চালানোর সুযোগ পান তিনি। গতকাল শনিবার মুঠোফোনে গৃহবধূর বাবা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ওই মামলা আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। আমার মেয়ে এখন স্বামীর ঘরে সংসার করতেছে। সে ভালো আছে। লিগ্যাল এইড অফিসের সহযোগিতা না পালি মামলা চালাতি আমার খুব কষ্ট হয়ে যাতো।’

জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, গত তিন বছরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির পাশাপাশি আর্থিকভাবে সচ্ছলতা নেই, এমন বিচারপ্রার্থীদের ৫৯৭টি মামলা সরকারি খরচে পরিচালনা করে দেওয়া হয়েছে। এসব মামলা পরিচালনার জন্য জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে ৮০ জন প্যানেল আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে, যাঁদের সহযোগিতায় গত ৩ বছরে ৪৫৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। পাশাপাশি বিনা মূল্যে হাজারো মানুষকে আইনি পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

সরকারি এ সেবার খবর মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে নানা রকম উদ্যোগ নিয়েছে জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়। জেলার পাশাপাশি প্রতিটি উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে রয়েছে লিগ্যাল এইডের কমিটি। এসব কমিটিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা সদস্য হিসেবে রয়েছেন। প্রতি মাসে একবার অথবা দুই মাসে একবার করে এসব কমিটির সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। পাশাপাশি প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়সহ জেলার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় লিগ্যাল এইড কার্যালয়ের সেবার বর্ণনা দিয়ে তথ্যবোর্ড টানানো হয়েছে।

শ্রীপুর উপজেলার কাদিরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন বলেন, ‘গ্রাম আদালতে আমরা যেসব বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারি না, সেগুলো লিগ্যাল এইড অফিসে পাঠিয়ে দিই। পাশাপাশি গ্রামের অসচ্ছল মানুষদেরও সেখানে যাওয়ার পরামর্শ দিই।’

মাগুরা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) এস্কেন্দার আজম বলেন, আর্থিকভাবে অসচ্ছল বা গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে আদালত ও মামলা নিয়ে একটা ভীতি রয়েছে। এসব মানুষের জন্য লিগ্যাল এইড কার্যালয় কার্যকর ভূমিকা রাখছে। লিগ্যাল এইডের সেবার খবর এখন গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে।