‘নাতিটাকে যেন কারও কাছে হাত পাততে না হয়’

সড়ক দুর্ঘটনায় সিয়ামের ডান পা হাঁটুর ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বাঁ পা সোজা করতে পারে না।

বই নিয়ে খেলছে শিশু সিয়াম। পাশে তার মা। গত সোমবার দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার নান্দেরাই ডুজুপাড়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো

সিয়াম বাবুর বয়স তিন বছর পাঁচ মাস। তার বয়সী পাড়ার অন্য ছেলেরা দৌড়ঝাঁপ দেয়, লুকোচুরি খেলে। মা-বাবার কাছে বল কেনার বায়না ধরে। সিয়াম এসব কিছুই করতে পারে না। ঘুমানোর সময়টুকু বাদ দিলে মা-বাবা-দাদা-দাদির কোলে শুয়ে–বসে দিন কাটে তার।

সিয়ামের বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার নান্দেরাই ডুজুপাড়া গ্রামে। আরিফুল ইসলাম-সালেহা বেগম দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান সিয়াম। গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে উপজেলার বেলতলী বাজার এলাকায় পার্বতীপুর-দিনাজপুরগামী মালবোঝাই ট্রাকের চাকার নিচে পড়ে ডান পা গোড়ালির ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তার। বাঁ পায়েও গুরুতর আঘাত লাগে। পরে চিরিরবন্দর হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখান থেকে রেফার্ড করা হয় এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা হয় সিয়ামের। ডান পা হাঁটুর ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বাঁ পা সোজা করতে পারে না। এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়েছে সিয়াম। চিকিৎসক জানিয়েছেন, অস্ত্রোপচার করা হলে বাঁ পা ঠিক হয়ে যাবে। এর জন্য লাগবে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা।

গত সোমবার ডুজুপাড়া গ্রামে সিয়ামের বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, তিন শতক জমিতে টিনের ছাপরা দেওয়া একটি মাটির ঘর। ছোট্ট উঠানে একটি চুলা। সেখানে রান্না হয়। পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় চুলার পাশে একটি গর্তে ময়লা পানি জমে আছে। বারান্দায় চটের বস্তার ওপর সিয়ামকে কোলে নিয়ে বসে আছেন মা সালেহা বেগম। জানালেন, দুর্ঘটনার কয়েক দিন আগে থেকে পেটের পীড়ায় ভুগছিল সিয়াম। সেদিন (গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর) সকালে ছেলেকে নিয়ে চিরিরবন্দর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। ভ্যানওয়ালাকে ভাড়া দিতে গিয়ে দেখেন, তাঁর কাছে ভাংতি টাকা নেই। রাস্তার বিপরীত পাশে সিয়ামের দাদার পান-সিগারেটের দোকান। ছেলেকে নিয়ে রাস্তা পার হন। ওই দোকানে ছেলেকে রেখে ভাংতি টাকা নিয়ে ভ্যানওয়ালাকে পরিশোধ করে আবার ছেলের কাছে ফিরছিলেন। সিয়ামও এগিয়ে আসছিল। এমন সময় ট্রাক এসে ধাক্কা দেয় তাকে।

সিয়ামের বাবা আরিফুল ইসলাম (৩৮) রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করতেন। মাস পাঁচেক আগে চিরিরবন্দরে এক ডিলারের ঘরে (খাদ্যপণ্য বিক্রেতা) ডেলিভারিম্যানের চাকরি নিয়েছেন। আরিফুল বলেন, ‘ট্রাকের মালিক এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন। আশপাশের কয়েকটি বাজারে সাহায্য তুলেছি। দুটি গরু বিক্রি করেছি। চার লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। কয়েক দিন আগে চিরিরবন্দরে চিকিৎসক আমজাদ হোসেনকে দেখিয়েছি। চিকিৎসা করার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।’

সিয়ামের বাড়ি থেকে ফিরে বেলতলী বাজারে তার দাদা খলিলুর রহমানের সঙ্গে দেখা হয়। আলাপচারিতায় সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া—তিন পুরুষে বংশে কোনো ভিক্ষুক নেই। নাতিটাকে যেন কারও কাছে হাত পাততে না হয়।’ এরপর গলা ধরে আসে খলিলুরের।