কারও দান, কারও শ্রমে সবার জন্য হাসপাতাল

শমশেরনগর হাসপাতাল ভবনপ্রথম আলো

একজন জমি দিয়েছেন তো আরেকজন অ্যাম্বুলেন্স। কেউ সরঞ্জাম কিনে দিয়েছেন, কেউ আবার নগদ টাকা। এর সঙ্গে কিছু মানুষের স্বপ্ন আর উদ্যম মিলে গড়ে উঠছে ‘সকলের জন্য হাসপাতাল’।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর ইউনিয়নের মরাজানেরপাড় এলাকায় নবনির্মিত হাসপাতাল ভবনটি ‘দশে মিলে করি কাজের’ একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রবাসীদের সহায়তায় গড়ে ওঠা এই হাসপাতালে চিকিৎসক বসছেন। নিয়মিত রোগীও দেখছেন।

শমশেরনগর হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। গত ১৩ মার্চ স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ১০ শয্যার হাসপাতালের অনুমোদনও পাওয়া গেছে। যেটিকে ধাপে ধাপে ১৫০ শয্যায় উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, সকলের জন্য একটি হাসপাতাল স্লোগানে তাঁরা এখানে ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার উন্নত মানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে চান। অলাভজনক এই হাসপাতালের উদ্দেশ্য বিনা মূল্যে চিকিৎসা নয়, আবার মুনাফাও নয়। ধনী ও সচ্ছল রোগীরা চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করবেন। মধ্য আয়ের রোগীরা কম টাকায় আর দরিদ্র-প্রান্তিক আয়ের মানুষ বিনা মূল্যে একই সেবা পাবেন।

হাসপাতালের মতো একটি ভালো উদ্যোগে সাড়া দিয়ে মরাজানেরপাড়ে ১৫১ শতাংশ জায়গা দান করেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সরওয়ার জামান রানা ও আলেয়া জামান। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা।

যেভাবে শুরু মহতী উদ্যোগের

কমলগঞ্জের শমশেরনগর ইউনিয়ন, মুন্সীবাজার, রহিমপুর, পতনঊষারসহ রাজনগরের কামারচাক, কুলাউড়ার শরীফপুর, হাজীপুর ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকার মানুষের স্থানীয়ভাবে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ নেই। তাঁদের উপজেলা সদরের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নয়তো জেলা সদরের হাসপাতালে যেতে হয়। দূরত্ব এবং আর্থিক সংকটে অনেকের পক্ষেই তাৎক্ষণিক চিকিৎসা গ্রহণ সম্ভব হয় না। এতে শারীরিক নানা রকম জটিলতার সম্মুখীন হন অনেকেই। মানুষের এই অসুবিধা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলাপ–আলোচনা চলছিল।

হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটি ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বছর পাঁচেক আগে হাসপাতাল করার বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনায় আসে। শমশেরনগরের মানুষ যুক্তরাজ্যপ্রবাসী ময়নুল ইসলাম খান তৎপরতা শুরু করেন। খোঁজ করেন জমির। হাসপাতালের মতো একটি ভালো উদ্যোগে সাড়া দিয়ে মরাজানেরপাড়ে ১৫১ শতাংশ জায়গা দান করেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সরওয়ার জামান রানা ও আলেয়া জামান। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা।

হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে থাকা প্রচুর প্রবাসী সাড়া দেন। এগিয়ে আসেন দেশের ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার মানুষও।

জমি নিশ্চিতের পর দরকার ভবন করার টাকা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ খুলে অর্থ সংগ্রহের প্রচার চালানো হয়। হাসপাতাল বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত করা হলো শমশেরনগরেরই সন্তান সংগীতশিল্পী সেলিম চৌধুরীকে। তিনি হলেন কমিটির সভাপতি। তাঁর নেতৃত্বে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কমিটির সহসভাপতি মুজিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালামসহ অনেকে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে ময়নুল ইসলাম খান, যুক্তরাষ্ট্রে রফিক উদ্দিন চৌধুরী ও সাইফুর রহমান কামরানের সমন্বয়ে দ্রুতই অর্থের সংস্থান হতে থাকে।

বিন্দু বিন্দু দানে মহাসিন্ধু

হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে থাকা প্রচুর প্রবাসী সাড়া দেন। এগিয়ে আসেন দেশের ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার মানুষও। ২০২০ সালের আগস্ট থেকে গত ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ২ কোটি ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৪৩৩ টাকা অনুদান পাওয়ার কথা জানিয়েছে হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটি।

তাদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, জায়গা নিবন্ধন, মাটি ভরাট, ভবন নির্মাণ, সরঞ্জাম ক্রয়সহ আনুষঙ্গিক ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ১৭ লাখ ৯ হাজার ৭০৪ টাকা। ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসাবে ৫০ লাখ, চলতি আমানত ৩০ লাখ, পরিচালন হিসাবে ৭ লাখ ২৫ হাজার এবং জাকাত তহবিলে ৩ লাখ টাকা আছে। ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট থেকে শুরু হয় একটি তিন তলাবিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবনের কাজ। যার একতলার কাজ শেষ হয়েছে।

হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির সহসভাপতি মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রোগীর শয্যা (বেড), পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি অনেকটাই কেনা হয়ে গেছে। কিছু আসার পথে আছে। এর কিছু নগদ টাকায় কেনা হয়েছে, কিছু সরাসরি ব্যক্তিপর্যায় থেকে অনুদান পাওয়া গেছে। যুক্তরাজ্যপ্রবাসী শিবলি আহমদ তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স দিয়েছেন। আরও অনেকের প্রতিশ্রুতি আছে।

চলছে সেবাদান, শিগগির উদ্বোধন

সম্প্রতি শমশেরনগর ইউনিয়নের মরাজানেরপাড়ে গিয়ে দেখা গেছে, মৌলভীবাজার-শমশেরনগর সড়কের দক্ষিণ পাশে একটি নতুন ভবন। তখন বৃষ্টি ঝরছিল। ভবনের গ্রিলে ছিল তালা। ফোন পেয়ে সেখানে আসেন হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির সহসভাপতি মুজিবুর রহমান।

এরপর ভবনে ঢুকে দেখা গেছে, অভ্যর্থনা, চিকিৎসকের বসার স্থান, এক্স-রে, প্যাথলজি, প্রসূতিকক্ষসহ বিভিন্ন কক্ষকে কাজের উপযোগী করে প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসার বিভিন্ন সরঞ্জামও কেনা হয়েছে। ভবনের বাইরে হাসপাতালের নির্ধারিত জায়গা মাটি ভরাট করে পরবর্তী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। হাসপাতাল-সংশ্লিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণের কাজ চলছে।

মুজিবুর রহমান জানান, এ পর্যন্ত শমশেরনগর হাসপাতালে একজন চিকিৎসক, একজন নার্স এবং একজন অভ্যর্থনাকারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ওই চিকিৎসক শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহে ছয় দিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পরীক্ষামূলক রোগী দেখছেন। জুনের প্রথম সপ্তাহে হাসপাতালের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হওয়ার কথা রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রথম পর্যায়ে ছয় মাস আট ঘণ্টা করে শুধু বহির্বিভাগে রোগী দেখা হবে। পরবর্তী ছয় মাস ১৬ ঘণ্টা করে হাসপাতাল খোলা রাখা হবে। এ সময় অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। এরপর ২৪ ঘণ্টা হাসপাতাল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।

হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যরা জানান, দ্বিতীয় তলার কাজও অচিরেই শুরু হবে। ফয়জুল হক নামের যুক্তরাজ্যপ্রবাসী একজন উদ্যোক্তা দ্বিতীয় তলার কাজটি করে দেবেন। সেখানে কিডনি ইউনিট চালু করা হবে। তৃতীয় তলার কাজ করে দেবেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসীরা। আগামী বছর (২০২৫) থেকে ১৫০ শয্যার হাসপাতালের কাজ শুরুর সম্ভাবনা আছে। এই প্রকল্পে একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট ও মেডিকেল কলেজ গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।

শমশেরনগর হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি সেলিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি গানের মানুষ। কিন্তু আমাকে এমনভাবে সম্পৃক্ত করা হয়েছে, দেখলাম যুক্ত না হলে উদ্যোগটি অগ্রসর না–ও হতে পারে। আমরা গুরুত্ব দিয়েই কাজ করছি। প্রথমে ছোট কিছু করার উদ্যোগ ছিল। কিন্তু মানুষের সাড়া দেখে এখন ১৫০ শয্যার হাসপাতাল করার চিন্তা করছি।’