বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে সহ–উপাচার্যের বিতর্কিত বক্তব্য, শিক্ষকদের পাল্টাপাল্টি বিবৃতি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সভায় বক্তব্য দেন সহ–উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খানছবি: প্রথম আলো

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খানের বিতর্কিত বক্তব্যের পর পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দিয়েছেন শিক্ষকেরা। আজ মঙ্গলবার রাতে শুরুতে বক্তব্যের সমর্থনে বিবৃতিতে দেন ১০১ শিক্ষক। পরে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম পাল্টা বিবৃতি দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে।

১০১ শিক্ষকের বিবৃতিতে বলা হয়, সহ-উপাচার্যের বক্তব্যের কিছু অংশ খণ্ডিতভাবে প্রচার করে একটি মহল উদ্দেশ্যমূলক বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খানের ‘অবান্তর’ মন্তব্য এবং পরবর্তী কর্মকাণ্ডে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিকৃত করার দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়েছে।

মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (একাডেমিক) পদে দায়িত্ব নেন। তিনি এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি ও জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের রাজনৈতিক সংগঠন ‘সাদা দলের’ আহ্বায়ক ছিলেন। তবে বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের ‘জাতীয়বাদী শিক্ষক ফোরাম’ নামে আলাদা একটি সংগঠন আছে। ওই সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দাবি, সাদা দল শুধু জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন। বিবৃতি দেওয়া ১০১ শিক্ষক ‘সাদা দল’-এর রাজনীতিতে যুক্ত।

১০১ শিক্ষকের বিবৃতিতে যা আছে

বিবৃতিতে শিক্ষকেরা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে আড়াল করে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলের নামে যে প্রচার চালানো হচ্ছে, তা সরাসরি ইতিহাস বিকৃতি। অতীতের মতো বর্তমানেও একটি মহল ফ্যাসিবাদী ধারার অনুসরণে মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জনগণ এই অপচেষ্টাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় সহ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খানের বক্তব্য খণ্ডিতভাবে প্রচার করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে—এমন অভিযোগও তোলা হয় বিবৃতিতে। যদিও তাঁর বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষকেরা বলেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে বক্তব্যের কিছু অংশ আলাদা করে প্রচার করা হচ্ছে, যদিও এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতিমধ্যে ব্যাখ্যা দিয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, অধ্যাপক শামীম উদ্দিন খান শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে অবমাননা করে এমন কোনো মন্তব্য করেননি; বরং তিনি হত্যাকাণ্ডের প্রকৃতি ও পরিকল্পনা নিয়ে আরও প্রামাণ্য গবেষণার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরুর পর ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সে সময় পাকিস্তানি বাহিনী ছিল পলায়নরত। পরবর্তী সময়ে মিত্রবাহিনীর পরিচয়ে ভারতীয় সেনাদের অবাধ লুটতরাজের অভিযোগ ওঠে, যার প্রতিবাদ করেছিলেন মেজর আ. জলিলসহ একাধিক দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। বিবৃতিতে দাবি করা হয়, জহির রায়হানসহ বহু বুদ্ধিজীবী হত্যার দায় তখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওপর বর্তায়। তাই বিজয়ের প্রাক্কালে সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রকৃত কারণ এবং এর নেপথ্যের হত্যাকারী চক্র চিহ্নিত করতে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের দাবি জানান শিক্ষকেরা।

১০১ জন শিক্ষক এই বিবৃতি দেওয়ার বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ইসমত আরা। তিনি জানান, সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেই এই বিবৃতি প্রস্তুত ও প্রকাশ করা হয়েছে।

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী শিক্ষকদের মধ্যে আছেন ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ইসমত আরা, পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল আজিম, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মো. শহীদুল হক, আরবি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ নেজাম, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ইকবাল সরোয়ার প্রমুখ।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষক আছেন ৯৯৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৭০২, নারী ২৯৪ জন।

আরও পড়ুন

‘সহ-উপাচার্যকে ক্ষমা চাইতে হবে’

জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের পক্ষে সভাপতি মোহাম্মদ আল আমীন ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান চৌধুরী স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের অস্তিত্ব, আত্মপরিচয় ও স্বাধীনতার ভিত্তি। এই ঐতিহাসিক সত্যকে খাটো করা, বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা প্রদান করা কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে এমন একজন ব্যক্তির কাছ থেকে, যিনি একটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের দায়িত্বশীল প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘দেশপ্রেমিক ছাত্রসংগঠনগুলোর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিভ্রান্তিকর ও দায়সারা ব্যাখ্যা প্রচার করেছে এবং আজ ১০১ জন শিক্ষক বিবৃতি দিয়েছেন। আমরা মনে করি, এসব কর্মকাণ্ড দায়িত্বশীল পদে থেকে ইতিহাসের প্রশ্নে অসত্য, বিভ্রান্তি বা বিকৃতি ছড়ানোকে আড়াল করার হীন প্রয়াস, যা কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাকেই ক্ষুণ্ন করে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভ্রান্ত ইতিহাসে দীক্ষিত করার শামিল।’

আরও পড়ুন

জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম বলেছে, মুক্তিযুদ্ধ কোনো ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার বিষয় নয়। এটি জাতির সর্বসম্মত ইতিহাস। একে বিকৃত করার যেকোনো প্রচেষ্টা জাতির চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার নামান্তর।

বিবৃতিতে অবিলম্বে সহ-উপাচার্যের বক্তব্যের প্রকাশ্য ও নিঃশর্ত প্রত্যাহার, ইতিহাস বিকৃতির জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা, ভবিষ্যতে এ ধরনের দায়িত্বহীন বক্তব্য থেকে বিরত থাকার দৃঢ় অঙ্গীকারের দাবি জানানো হয়। এতে আরও বলা হয়, ‘বিবৃতি দেওয়া ১০১ জন ব্যতীত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোয় সত্য, ইতিহাস ও জাতীয় মর্যাদা রক্ষায় সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধে আমরা ঐক্যবদ্ধ।’

আরও পড়ুন

সমালোচনার সূত্রপাত যেভাবে

এর আগে গত রোববার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় সহ-উপাচার্য (একাডেমিক) মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেন, ‘যে সময় আমি (পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী) দেশ থেকে পালানোর জন্য চেষ্টা করছি, আমি জীবিত থাকব না মৃত থাকব, সে বিষয়ে কোনো ফয়সালা হয়নি; সে সময় পাকিস্তানি যোদ্ধারা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করবে, এটি আমি মনে করি রীতিমতো অবান্তর।’ এ ছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন।

সেদিন ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি মোহাম্মদ আল আমীন। তিনি সহ-উপাচার্যের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে প্রথম আলোকে বলেছেন, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও রাজাকার, আলবদর-আলশামস দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে যখন দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পারে যে তাদের পরাজয় অনিবার্য, তখন তারা জাতির বরেণ্য সন্তানদের হত্যা করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার অভিপ্রায়ে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছিল।

অনুষ্ঠানের শেষেই অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খানের বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সমালোচনা হতে থাকে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক ভাষ্যকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাঁর এ বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা করেন। ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তোলেন।

বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলসহ ছয়টি সংগঠন তাঁর পদত্যাগের দাবি করে। এ দাবিতে তারা গতকাল সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে রাখে। ফলে রাত প্রায় পৌনে ৯টা পর্যন্ত ভবনটিতে আটকা ছিলেন সহ-উপাচার্য (একাডেমিক) মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান, সহ-উপাচার্য (প্রশাসনিক) মো. কামাল উদ্দিন ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। এ ছাড়া ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীরা সহ-উপাচার্য মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খানকে বর্জন করেন। গতকাল ওই বিভাগে বিদায় অনুষ্ঠান হয়েছে। একই দিনে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিবৃতি দিয়ে জানান, তাঁরা সহ-উপাচার্যের বক্তব্য সমর্থন করেন না।

এদিকে আজ মঙ্গলবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে এক সভার আয়োজন করা হয়েছিল। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন সহ-উপাচার্য মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান। শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার অভিযোগে সে সভা বর্জন করেন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) এজিএসসহ হল সংসদের ৯ প্রতিনিধি। এমনকি এ ঘটনার জের ধরে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হট্টগোল হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।