স্বামীকে শেষবিদায় দিতে এসে জানলেন দুই ছেলেও নেই

স্বামীর মৃত্যুর পর দুই ছেলেকে হারানোর শোক। কোনোভাবেই এই নিষ্ঠুর নিয়তি মানতে পারছেন না সেলিনা আক্তার। আজ মঙ্গলবার বেলা আড়াইটায় চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের শায়ের পাড়া এলাকায়
প্রথম আলো

সেলিনা আক্তার যখন ওমানে ছিলেন, তখন দেশে এসে হৃদ্‌রোগে মারা যান স্বামী। স্বামীকে বিদায় দিতে তিনি ছুটে আসেন দেশে। স্বামীর শোকে কাতর সেলিনা দেশেই রয়ে যান। তিন মাসও পার হয়নি। এবার খবর এল ওমানের সমুদ্রসৈকতে গোসল করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন বুকের ধন দুই ছেলে। পাগলপ্রায় সেলিনা এখন বাক্‌রুদ্ধ, দিশাহারা। এমন শোকের সমুদ্র পেরিয়ে তিন দশকের প্রবাসজীবনে তিনি কী করে ফিরবেন, জানেন না।

সেলিনা আক্তারের দুই ছেলে মুহাম্মদ আব্বাস হোসেন (২৫ ) ও মুহাম্মদ আজাদ হোসেন (২০) গত রোববার দিবাগত রাত তিনটার দিকে ওমানের আস শিফা সৈকতে গোসল করতে নেমে পানির স্রোতে তলিয়ে মারা যান তাঁরা। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার নাজিরহাট পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চাঁদগাঁও পাড়ায় সেলিনার শ্বশুরবাড়ি। তিন মাস আগে এখানেই তাঁর স্বামী আহমদ হোসেনের (৫৫) মৃত্যু হয়েছে।

শোকে কাতর সেলিনা আক্তার এখন উপজেলার ধুরং এলাকার সায়েরপাড়া গ্রামে বাবার বাড়িতে আছেন। আজ মঙ্গলবার বেলা দুইটার দিকে ওই বাড়ির আঙিনায় পা দিতেই কানে আসে সেলিনার আহাজারির শব্দ।

বাড়ির বাসিন্দারা জানালেন, আজ থেকে তিন দশক আগে মধ্যপ্রাচ্যের ওমানে পাড়ি জমান আহমদ হোসেন (৫৫) ও তাঁর স্ত্রী সেলিনা আক্তার (৪৫)। পরে সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তাঁরা। ছয় ছেলের জন্মও সেখানে। এর মধ্যে ওমানে ব্যবসা-বাণিজ্যে আয় উন্নতিও হয়েছে তাঁদের। গত কয়েক মাস আগে দেশে বাড়ির নির্মাণকাজ দেখতে আসেন আহমদ হোসেন। দেশে আসার পর হঠাৎ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। ওমানে বসে তাঁর স্ত্রী সেলিনা সেই সংবাদ শুনে ছুটে আসেন স্বামীকে শেষবিদায় দিতে। মায়ের সঙ্গে ছয় ছেলেও আসে দেশে। এর মধ্যে তিনজন ফিরেও যান ব্যবসার কাজে। ফিরে যাওয়া তিন ছেলের মধ্য দুই ছেলে এখন নেই।

দোতলা বাড়ির ওপরের তলার শোয়ার ঘর থেকে সেলিনার কান্নার শব্দ আসছিল। কিছুক্ষণ পর দুজন স্বজনের সহায়তায় নেমে আসেন বৈঠকখানায়। কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় তিনি বলছিলেন, ‘আঁর দুই পোয়ারে আনি দও (আমার দুই ছেলেকে এনে দাও)। দুই পোয়া ছাড়া ডানে থাইক্কুমরে বাপ (আমার দুই ছেলেকে ছাড়া আমি কেমনে থাকব বাবা)। তিন মাস আগে আর জামাইরে লইগেলগুই। এহন দুই পুয়ারে কেনে নিলরে। (তিন মাস আগে আমার স্বামীকে নিয়ে গেল। আর এখন নিয়ে গেল দুই ছেলেকে)।’

রোববার নিহত দুই ছেলের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় মা সেলিনার। তাঁরা মা এবং দেশে থাকা তিন ভাইয়ের খবর নিয়েছেন। ওমানে ফিরে যাওয়ার জন্য বিমানের টিকিট করছেন কি না জানতে চেয়েছেন।

সেলিনা বলেন, ‘দুই ছেলে বারবার বলছিল, মা তোমাকে ছাড়া ভালো লাগছে না। ভাইদের নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসো।’ সেলিনা জবাবে তাঁদের বলেছিলেন, তাঁদের বড় ভাই আক্তারের জন্য বউ ঠিক করে আসবেন। কিন্তু এর মধ্যে সব এলোমেলো হয়ে গেল।

সেলিনার তিন ছেলে আকতার হোসেন (২৬), আয়মন হোসেন (১৩) ও আয়াজ হোসেন (৯) মায়ের সঙ্গে এখন দেশে আছে। বাবা ও দুই ভাইয়ের মৃত্যুতে তারাও বাক্যহারা।

সেলিনার বড় ছেলে আকতার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন সৈকতে তাঁর দুই ভাই যখন গোসলে নেমেছিলেন, তখন হঠাৎ পানি বেড়ে যায়, যা তাঁরা খেয়াল করেননি। এরপর পুলিশ সৈকতের কাছে আব্বাসকে ভাসমান অবস্থায় পায়। কিন্তু আজাদ নিখোঁজ ছিল। এক ঘণ্টা পর পানি সরলে বালুর স্তূপে খুঁড়ে পাওয়া যায় আজাদের লাশ।