চলতে-লিখতে না পারা জ্যোতি পেলেন জিপিএ-৫

জিপিএ-৫ পাওয়া জ্যোতি হোসেন
ছবি: প্রথম আলো

ছোটবেলা থেকে দুরন্ত ছিলেন জ্যোতি হোসেন। সাড়ে তিন বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর ঘাড়ের শিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং একটি হাড় ভেঙে যায়। এতে হাত ও পা বিকল হয়ে যায়। চলাচলের শক্তি হারিয়ে জ্যোতির নিত্যসঙ্গী হয় হুইলচেয়ার। থেমে যায় তাঁর সব দুরন্তপনা।

দুর্ঘটনার পর নিজের হাতে লেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন জ্যোতি। বাঁ হাতে কিছুটা লিখতে পারলেও তা যথেষ্ট নয়। যে কারণে পরীক্ষার হলে একজন সহকারী নেন। জ্যোতি মুখে বলেন আর ওই ব্যক্তি পরীক্ষার খাতায় তা হুবহু লেখেন। এভাবে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছেন এই অদম্য মেধাবী।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার সরকারি শহীদ মসিয়ূর রহমান ডিগ্রি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন জ্যোতি হোসেন। তিনি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার পারবাজার গ্রামের কাদের হোসেন ও রেক্সনা হোসেনের মেয়ে। তাঁর এ ফলাফলে উচ্ছ্বসিত মা–বাবা।

দুই বোনের মধ্যে বড় জ্যোতি হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছর আগে ঝিকরগাছা পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান তিনি। এরপর প্রথম আলো ট্রাস্টের উপবৃত্তির টাকায় কলেজে ভর্তি হন।

জ্যোতিকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া ও আসার কাজটি করেন তাঁর মা রেক্সনা হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাড়ে তিন বছর বয়সে জ্যোতিকে একটি স্কুলে নার্সারিতে ভর্তি করেছিলাম। ওই বছর একদিন আমরা সবাই ভ্যানে করে ঝিকরগাছা থেকে শহরের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন একটি দুর্ঘটনা ঘটে। ভ্যান থেকে পড়ে যায় জ্যোতি। এরপর সে চলাচলের ও ডান হাতে লেখার শক্তি হারিয়ে ফেলে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাঁ হাতে লিখে পরীক্ষা দিয়েছে। পরে একজন শিক্ষকের পরামর্শে পরীক্ষার সময়ে তাকে সহকারী দেওয়া হয়। মাধ্যমিক পর্যন্ত জ্যোতির ছোট বোন জেবা হোসেন সহকারী হিসেবে লিখে দিয়েছে। কিন্তু এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ায় শিক্ষা বোর্ড তাকে অনুমোদন দেয়নি। এ কারণে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিরিয়র খাতুন তার সহকারী ছিল।’

জ্যোতির বাবা আবদুল কাদের দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। তাঁর আয়ে সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছিল। কিন্তু জ্যোতির চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে এখন তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। আবদুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলাম। এখন দেশেই থাকব। জ্যোতি চলতে–ফিরতে পারে না বলে ওকে নিয়ে খুব টেনশন হতো। এখন আর সেই টেনশন নেই। মেয়ের সাফল্যে আমরা আনন্দিত।’

সরকারি শহীদ মশিয়ূর রহমান ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ বিপ্লব কুমার সেন বলেন, ‘জ্যোতির কঠিন সংগ্রামের জীবন। সংগ্রামের মূল্যও সে পেয়েছে। আমরাও ওর পাশে থাকার চেষ্টা করেছি।’

এখন বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখছেন জানিয়ে জ্যোতি হোসেন বলেন, ‘আমার সফল্যের জন্য পরিবারের সবাই অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। এখনো করছে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা রয়েছে। ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।’