রাঙামাটির ২০০ কোটি টাকার হলুদের বাজার হতে পারে হাজার কোটির

ঝুড়িতে শুকনো হলুদ নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় বসে আছেন কয়েকজন চাষি। সম্প্রতি রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া হাটেছবি: সুপ্রিয় চাকমা।

জুম খেতে সাথি ফসল হিসেবে চাষ করা হলুদ পাহাড়ের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। পার্বত্য তিন জেলায় হলুদের চাষ ধীরে ধীরে হলেও বাড়ছে। চলতি মৌসুমে রাঙামাটিতে জেলায় ২০০ কোটি টাকার হলুদ বিক্রি হয়েছে। তবে ব্যাংকঋণ, সংরক্ষণাগার, প্রক্রিয়াজাত কারখানাসহ নানা সুবিধা দিলে বছরে হাজার কোটি টাকার হলুদ চাষ করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হলুদ মূলত জুম খেতে চাষ করা তিল, কলা, আদা, মরিচসহ অন্তত ৫০ জাতের সাথি ফসলের একটি। পাহাড়ের মানুষ পরিবারের চাহিদা মেটাতে জুমে হলুদ রোপণ শুরু করেন। তবে সারা দেশে হলুদের চাহিদা থাকায় এখন প্রত্যেক জুমিয়া পরিবার বিক্রির জন্য হলুদের চাষ বাড়িয়েছেন। আগের তুলনায় হলুদ চাষ বহুগুণ বেড়েছে। তবে হলুদচাষিরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা, ব্যাংকঋণ—কোনো কিছুই পান না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাহাড়ে হলুদ চাষের জন্য ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে ঝোপ-জঙ্গল কাটা হয়। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের দিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে টিলাগুলোর আগাছা পরিষ্কার করে হলুদ চাষের উপযোগী করতে হয়। টিলা চাষের উপযোগী হওয়ার পর কলা, মরিচ, বেগুন, তিলসহ অন্যান্য ফসলে সঙ্গে হলুদ চাষ করা হয়। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-মার্চ) মাসে হলুদের বীজ রোপণ করতে হয়। অন্যান্য ফসলের চেয়ে হলুদের পরিচর্যা করতে হয় কম। শুধু খেতের আগাছা পরিষ্কার করলেই চলে। পাহাড়ে হলুদের কোনো রোগবালাই নেই বললে চলে। সাত থেকে আট মাসের মধ্যেই হলুদ তোলার উপযোগী হয়। জুম চাষিরা ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাস থেকে হলুদ তোলা করা শুরু করেন। হলুদ তোলার পর সেদ্ধ করে ৮ থেকে ১০ দিন রোদে শুকালেই বাজারে বিক্রির উপযোগী হয়। প্রতি চার মণ হলুদ শুকালে এক মণ থাকে। সেই শুকনো হলুদ প্রতি মণ ৯ থেকে ১১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাঙামাটি জেলায় এবার শুকনো হলুদ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রতি এক হেক্টর জমিতে ৩ দশমিক ৬৫ মেট্রিক টন। মোট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ হাজার ৬২৫ মেট্রিক টন। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার হলুদের উৎপাদন বেশি হয়েছে বলে চাষিরা জানিয়েছেন। চলতি মৌসুমে প্রতি মেট্রিক টন শুকনো হলুদ বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। সেই হিসেবে এবার কমপক্ষে ১৯০ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকার হলুদ বিক্রি হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন হলুদ বিক্রি এখনই ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

সম্প্রতি রাঙামাটি জেলায় অন্তত ১০টি হাটবাজারে হলুদ বিক্রি দেখে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে বাজারে শুকনো হলুদ বিক্রি শুরু হয়। এপ্রিল পর্যন্ত বাজারগুলোতে হলুদ বিক্রি জমজমাট থাকে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাজারগুলো থেকে হলুদ কিনে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করেন। সদর উপজেলার কুতুকছড়ি বাজার, নানিয়ারচর উপজেলায় ঘিলাছড়ি বাজার, কাউখালী উপজেলা ঘাগড়া বাজার, বাঘাইছড়ি উপজেলা সাজেক ইউনিয়নে মাচালং বাজারসহ অন্তত ১৫টি বাজারে প্রতি হাটের দিন ১০ থেকে ৪০ মেট্রিক টন পর্যন্ত শুকনো হলুদ বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া আর ১০ উপজেলায় অন্তত ২৫০টি হাটবাজারের প্রতি সপ্তাহজুড়ে হলুদ বিক্রি হয়েছে।

বাঘাইছড়ি উপজেলা সাজেক ইউনিয়নে কিচিংপাড়া গ্রামের প্রধান (কার্বারি) ও হলুদচাষি বিজয় তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এক একর জমিতে ধান, কলা ও অন্যান্য ফসলের সঙ্গে হলুদ চাষ করেছি। সব উত্তোলন করে ১০ মণ শুকনো হলুদ বিক্রি করেছি। অন্যান্য বছরের তুলনা এবার হলুদের চাষ বেশি হয়েছে, ফলনও ভালো হয়েছে। হলুদচাষিরা বেশ লাভবান হয়েছেন।’

নানিয়ারচরের ঘিলাছড়ি বাজারের হলুদ ব্যবসায়ী আলো চাকমা ও ঘাগড়া বাজারের মো. এরশাদ প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর হলুদ চড়া দামে কিনতে হচ্ছে। আশপাশের তিনটি বাজার থেকে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১০০ মেট্রিক টন হলুদ কেনেন বলে তাঁরা জানান।

হলুদ বিক্রির পর পাওনা বুঝে নিচ্ছেন এক পাহাড়ি নারি। সম্প্রতি রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া হাটে
ছবি: সুপ্রিয় চাকমা।

রাঙামাটি সদর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা দেবাশীষ দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, জুমিয়ারা নিজেরাই হলুদ চাষ করেন। হলুদে রোগবালাই না থাকায় খুব বেশি পরামর্শ ও চাষের কৌশল, প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় না। এমনিতে পাহাড়ে হলুদের ফলন হয়। সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে কোনো হলুদচাষিদের কোনো সহায়তা দেওয়া হয় না।

রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মো. আবদুল ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখনো হলুদ বাজারে সঠিক টাকার হিসাব নিতে পারি না। এ বিষয় চেম্বার অব কমার্স কাজ করছে। আমাদের ধারণা, প্রতিবছর কয়েক শ কোটি টাকার হলুদ বিক্রি হয়। এসব হলুদ রাঙামাটি জেলার বাইরে নেওয়া হয়।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর ১০ উপজেলায় প্রায় পাঁচ হাজার একর হলুদ চাষ হয়েছে। ৪ মণ কাঁচা হলুদে এক মণ শুকনো হলুদ হিসাব করে ৭ হাজার ৬২৫ মেট্রিক টন শুকনো হলুদ উৎপাদন হওয়ার কথা। ইতিমধ্যে হলুদ বিক্রি প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেই হিসাবে প্রায় ২০০ কোটি টাকার হলুদ বিক্রি হয়েছে। তবে ফলন ভালো হওয়ায় এর চেয়ে বিক্রি বেশি হয়েছে বলে তিনি ধারণা করেন।