৩০ ভাগ করে ৭০ ভাগের বিল

খুলনার বটিয়াঘাটার নির্মাণাধীন একটি সেতুর মাত্র ‘৩০ শতাংশ’ কাজ শেষ হয়েছে। তবে ঠিকাদারকে ৭০ শতাংশ কাজের বিল পরিশোধ করা হয়েছে।

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সুরখালি ইউনিয়নের নাইনখালী নদীর ওপর নির্মাণাধীন সেতুর শুধু পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। এখনো অনেক কাজ শেষ হয়নি। গত ২২ মার্চ তোলাছবি: প্রথম আলো

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলায় নির্মাণাধীন একটি সেতুর মাত্র ‘৩০ শতাংশ’ কাজ শেষ হলেও ঠিকাদারকে ৭০ শতাংশ কাজের বিল পরিশোধ করা হয়েছে। খুলনার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কার্যালয়ে এমন অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। দেড় বছরে সেতুটির শুধু ২৮টি পিলার ও এক পাশের ভিত সম্পন্ন হয়েছে। ছাদ ও সংযোগ সড়কের কাজ এখনো বাকি।

সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে যুক্ত কয়েকজন ঠিকাদার বলেন, সেতুটির সর্বোচ্চ ৩০ ভাগ কাজ হয়েছে। তা ছাড়া পুরো কাজ শেষ হলেও সাধারণত ৮০ ভাগ কাজের বিল দেওয়া হয়। সেখানে অল্প কাজের জন্য ৭০ শতাংশ বিল পরিশোধ সত্যিই বিস্ময়কর। টাকা নেওয়ার পর এখন যদি ঠিকাদার কাজ না চলে যান, তাহলে দায় নেবেন কে? তাঁদের অভিযোগ, ওই বিলের জন্য ঠিকাদারের কাছ থেকে ৫ শতাংশ হারে ঘুষ নিয়েছেন এলজিইডি কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী এ কে এম আনিছুজ্জামান।

তবে এ কে এম আনিছুজ্জামান দাবি করেছেন, বিল পরিশোধে কোনো অনিয়ম হয়নি। নির্মাণাধীন সেতু এলাকার মাটি বেশ নরম। এ জন্য পাইলিং করতে ঠিকাদারের ৭৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ৭০ শতাংশ বিল পরিশোধ করা হয়েছে। ৫ শতাংশ ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।

এলজিইডি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বটিয়াঘাটার সুরখালী ইউনিয়নের নাইনখালী নদীর ওপর ৬০ মিটার দীর্ঘ একটি আরসিসি গার্ডার সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এসকেআই ও এমএসভি নামের যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেতুটির নির্মাণকাজ করছে। সেতুটি নির্মাণের জন্য প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর ৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয় খুলনার এলজিইডি কার্যালয়। চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরের ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু চুক্তির পর কাজের অগ্রগতি না হওয়ায় ২০২২ সালের ১১ মে একবার ওই ঠিকাদারকে চুক্তি বাতিলের চূড়ান্ত নোটিশ দিয়েছিল এলজিইডি কার্যালয়।

সূত্র জানায়, চুক্তি অনুযায়ী প্রথম ধাপে ঠিকাদারকে ৬৪ লাখ টাকা পরিশোধ করে এলজিইডি কার্যালয়। পরে গত ২১ মার্চ ঠিকাদারকে সেতুর ৭০ শতাংশ কাজের জন্য ৩ কোটি ১২ লাখ ১৪ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। ওই বিল পরিশোধের জন্য ৭৫ শতাংশ কাজ হয়েছে বলে ছাড়পত্র দিয়েছেন এলজিইডির বটিয়াঘাটা উপজেলার উপসহকারী প্রকৌশলী বি এম ফরিদুজ্জামান।

তবে বৃহস্পতিবার সেতু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সুরখালী বাজার থেকে পাকা সড়ক ধরে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণ দিকে গেলেই বিলের ভেতর দিয়ে একটি মাটির রাস্তা চলে গেছে। বালু ফেলে রাস্তাটি পাকা করার কাজ চলছে। রাস্তা ধরে প্রায় দুই কিলোমিটার গেলেই নাইনখালী নদী। নদীর এক পাড়ে সাংকেমারী ও অন্য পারে গায়েরহাট গ্রাম। সেতু নির্মাণের নদীতে আড়াআড়ি মাটির বাঁধ দেওয়া হয়েছে। বাঁধের মধ্যেই পাইল নির্মাণ করা হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নদীর পূর্ব পাড়ে আটটি পিলার নির্মাণ করা হয়েছে। কয়েকজন শ্রমিক পিলারের গোড়া থেকে মাটি সরিয়ে রাখছেন। এরপর নদীর মধ্যে আরও ছয়টি করে পিলার। পশ্চিম পাড়ে পিলারের ওপর ছোট একটি ভিত দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নির্মাণসামগ্রী।

এ সময় কয়েকজন নির্মাণশ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, যে পিলারের গোড়া থেকে মাটি সরানো হচ্ছে সেগুলোর ভার পরীক্ষা (ওয়েট টেস্ট) করা হবে। এ জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। পিলারের ওপর মোট ১৫০ টন ওজন দেওয়া হবে। এ জন্য বস্তায় বালু ভরা হচ্ছে। ওই বালু পিলারের ওপর তুলে ওজন পরীক্ষা করা হবে।

নির্মাণাধীন সেতুর কয়েকটি ছবি তুলে এলজিইডির দুজন ঠিকাদার ও দুজন প্রকৌশলীকে দেখিয়ে কত শতাংশ কাজ হয়েছে জানতে চাওয়া হয়। সবাই এক বাক্যে বলেন, ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কাজ হয়েছে। ৭০ শতাংশ কাজ তখনই হবে, যখন সেতুর ছাদ ঢালাই ও সেতু দৃশ্যমান হবে। বাকি ৩০ শতাংশ কাজ হলো সংযোগ সড়ক ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ।

ঠিকাদার শেখ ইদ্রিস আলী প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো সেতুর পাইলিংই প্রধান। পাইলিং হলেই সেতুর ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে যায়। সেই হিসেবেই বিল করা হয়েছে।