সাক্ষাৎকার

সুন্দরবনে প্রাণী সুরক্ষায় দরকার আরও বেশি কেল্লা ও মিঠাপানির আধার

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী। তিনি সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য গবেষণা করেন। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়েও কাজ করেন। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সুন্দরবনের ক্ষতি নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে তাঁর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন উত্তম মণ্ডল

প্রথম আলো:

সুন্দরবন উপকূলে গত ১৭ বছরে ১২টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০০৭ সালে সিডরের পর সুন্দরবনে ৪০টি হরিণসহ ৪২টি প্রাণীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর ৪টি এবং ২০২১ সালের ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ৪টি বন্য প্রাণীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। এবার রিমাল আঘাত হানার পর ১৪০টির মতো বন্য প্রাণীর মরদেহ পাওয়া গেল। এবার এতসংখ্যক প্রাণহানির কারণ কী?

আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী: সিডর ছিল সুপারসাইক্লোন। সেটা আঘাত হানার সময় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটারের বেশি। তবে সেটির মূল প্রভাব ছিল তিন থেকে চার ঘণ্টার মতো। আবার তখন জোয়ার ছিল না। আইলার গতি কম ছিল। ওই দুই ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। তবে বনের সব জায়গা ডুবে যায়নি। আবার এসব ঝড়ের প্রভাব নির্দিষ্ট জায়গায় ছিল। তবে রিমালের ক্ষেত্রে অন্য রকম হয়েছে। এযাবৎকালের ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রিমাল বজায় ছিল। ঘূর্ণিঝড় রিমালের অবস্থান এবং আঘাতের প্রভাব ছিল দীর্ঘ ৩০ ঘণ্টারও অধিক সময় ধরে, যার মধ্যে তিনবার ছিল পূর্ণ জোয়ার। আর ওই তিনবারই ঝড়ের প্রভাবে সেটি স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে অধিক মাত্রার জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে পরিণত হয়। মাঝে যে ভাটার সময়টুকু, তখন পানি নেমে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। কারণ, তখনো ঝড়ের প্রভাব উপকূলের মধ্যেই ছিল। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আগের ঝড়গুলোর কভারিং এরিয়া অনেক কম ছিল। এবার বনের পূর্ব, মধ্য, পশ্চিম—সবখানেই রিমালের ব্যাপক প্রভাব ছিল। পুরো বনই ডুবে ছিল। আগে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসগুলোয় প্রাণী এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এবার নিরাপদ আশ্রয় পায়নি। অতীতের কোনো ঘূর্ণিঝড়ই পুরো সুন্দরবনকে একসঙ্গে ডুবিয়ে দেয়নি এবং এত দীর্ঘ সময় ধরে এত উঁচু জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে বন ডুবে থাকেনি। তাই এবার প্রাণী মারা যাওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি।

প্রথম আলো:

মৃতদেহ পাওয়া বন্য প্রাণীর মধ্যে ৯৭ শতাংশের বেশি হরিণ...

আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী: সুন্দরবনের প্রায় সব প্রাণীই প্রতিনিয়ত জোয়ার-ভাটার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারে। বাঘ বিড়ালের জাত। গাছে উঠতে পারে। মোটকথা সুন্দরবনের প্রাণীদের মধ্যে হরিণ ও শূকর ছাড়া অন্য প্রাণী গাছে চড়তে পারে। ফলে বনের গহিনে যেখানে ঝোড়ো হাওয়ার প্রভাব তুলনামূলক কম, সেখানে হরিণ ছাড়া অন্য প্রাণীরা গাছের ডালে আশ্রয় নিতে পারে। হরিণের শরীরের ওপরের দিকটা ভারী ও উঁচু আর নিচে সরু লম্বা পা। এই পা দিয়ে গাছে উঠতে গেলে হরিণ ভারসাম্য হারায়। মানে শারীরিক গঠনগত কারণে হরিণ গাছের ডালে আশ্রয় নিতে পারে না। আবার হরিণ দ্রুততম প্রাণী হলেও এই তৃণভোজী প্রাণী দুর্বল প্রকৃতির। বয়স্ক হরিণের চেয়ে বাচ্চা হরিণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা শূকর বা অন্য প্রাণীর তুলনায় অনেক গুণ বেশি। এসব কারণেই হরিণের মৃত্যুর সংখ্যাটাও বেশি।

প্রথম আলো:

রিমালের পর সুন্দরবনের যতসংখ্যক বন্য প্রাণীর মৃতদেহ পাওয়া গেছে, বলা হচ্ছে প্রকৃত সংখ্যাটা কি আরও বেশি?

আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী: যত প্রাণী মারা গেছে, এর হিসাব পাওয়াটা দুষ্কর। ঝোপালো এবং গভীর বনে খোঁজ করা সম্ভব হয়নি। যা নির্ধারণ করা যাচ্ছে, তা শুধু বনের যেসব স্থানে সহজে গমনযোগ্য, তার একটি চিত্র। তবে যেটা দেখছি, সেটাই যে চিত্র, এমনটা নয়। এর চেয়ে অধিকসংখ্যক প্রাণী মারা যাওয়ার আশঙ্কাই সবচেয়ে বেশি।

প্রথম আলো:

দেখা যাচ্ছে যে সুন্দরবনের পশ্চিম অংশের চেয়ে এবার পূর্বে বন্য প্রাণী মারা গেছে বেশি। এটার কারণ কী?

আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী: সুন্দরবনে পশ্চিমে হরিণের সংখ্যা আগের চেয়ে কম। সুন্দরবন পূর্ব অংশের কটকা, কচিখালী, ডিমেরচর ও দুবলারচরে সবচেয়ে বেশি হরিণ মারা গেছে। এই চারটি জায়গা সমুদ্রের কাছাকাছি এবং উন্মুক্ত। ঝড়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই অংশে পুরো প্রভাব থাকে। আবার জোয়ারের শুরু থেকে ভাটার শেষ পর্যন্ত সেখানে পানি থাকে। পশ্চিমের অভয়ারণ্য সমুদ্রের এতটা কাছাকাছি উন্মুক্ত নয়। এ কারণে পশ্চিমে মৃত্যু কম।

প্রথম আলো:

সিডরের সময় থেকে ঘূর্ণিঝড়ের সময় অনেক উঁচু জোয়ার হচ্ছে। দিন দিন জোয়ারের উচ্চতা বাড়ছে। এমনকি স্বাভাবিক সময়েও উপকূলের নদ-নদীগুলোয় জোয়ারের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা কি শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ার অংশ?

আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী: জলবায়ু তো আছেই। এ ছাড়া পলির একটা বিষয় আছে। উপকূলের নদীগুলো ভরাট হচ্ছে। আবার বৃষ্টি কমে গেছে। সুন্দরবনের উপকূলে ওপরের দিক থেকে আসা (আপস্ট্রিম) পানির প্রবাহ কম হওয়া বা না থাকায় ধারাবাহিকভাবে লবণাক্ততা বাড়ায় ভূমির ক্ষয় হচ্ছে। ওপরের দিক থেকে পানির যদি একটা ধারাবাহিক প্রবাহ থাকত, তাহলে পলিটা জমতে পারত কম। একই সঙ্গে লবণটা কম আসত। লবণের জন্য কিন্তু মাটি ভেঙে যাচ্ছে। মাটির কণা একটা আরেকটার একটা লেগে থাকে, লবণাক্ত বাড়ায় সেই বন্ডিং দুর্বল হয়ে যায়।  মাটি ভেঙে পলি হচ্ছে। বন ভেঙে পার্শ্ববর্তী খাল-নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। নদীর নাব্যতা কমে পানি ধারণক্ষমতা কমায় জোয়ারের পানি ওপরের দিকে উপচে উঠছে।

প্রথম আলো:

সুন্দরবনের প্রাণীদের সুরক্ষায় বন বিভাগ কিছু মাটির কেল্লা করেছে। এগুলো কেমন কাজে আসছে?

আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী: যেহেতু এখন জলোচ্ছ্বাস বাড়ছে, তাই ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পরে সুপারিশ করা হয়েছিল, সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে অভয়ারণ্যগুলোয় প্রাণীদের, বিশেষ করে হরিণ ও শূকরের আশ্রয় নেওয়ার জন্য বনের গহিনে কিছু উঁচু মাটির স্থান বা কেল্লা তৈরির এবং ছোট ছোট মিঠাপানির পুকুর করে পাড়গুলোকে অধিকতর উঁচু করার, যাতে লোনাপানি পুকুরে না ঢোকে। কেল্লা ও পুকুরের পাড় দুই ক্ষেত্রেই চারপাশ ঢালু রাখার কথা বলেছিলাম, যাতে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় প্রাণীরা দৌড়ে গিয়ে সেখানে আশ্রয় নিতে পারে আবার পাড় ঢালু বেশি হলে জোয়ারের পানি উপচে পুকুরে ঢোকা বা পাড় ভাঙার আশঙ্কা কম থাকে। রিমালের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি মৃত হরিণ পাওয়া গেছে কটকার জামতলা ও দুবলারচর এলাকায়, সেখানে এখনো কেল্লা তৈরি করা হয়নি। কিছু কেল্লা তৈরি হলেও বন বিভাগ সেভাবে বাস্তবায়ন করেনি। তবে যেখানে কেল্লা আছে, সেখানে মৃত পশুর সংখ্যা কম।

প্রথম আলো:

সুন্দরবনের প্রাণী সুরক্ষায় কী ধরনের কাজ করা দরকার?

আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী: স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনা ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সুন্দরবনের প্রাণিকুলের নিরাপদ আশ্রয় নেওয়া এবং জীবন রক্ষা সহজ করতে পারে। যেমন অধিকসংখ্যক কেল্লা তৈরি, মিঠাপানির আধার তৈরি, পুকুরের পাড় উঁচু করা ও সংস্কার করতে হবে। তবে এসব কাজ করতে গিয়ে যেন প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত না হয়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। এখন শব্দ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র পাওয়া যায়। এটা ব্যবহার করেই কাজগুলো করতে হবে।

সুন্দরবনের প্রাণী সুরক্ষায় কেল্লা ও মিঠাপানির আধার তৈরি করতে হবে।