সেরা জয়িতা কল্যানী মিনজিকে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘তুমি অনেক সাহসী, এগিয়ে যাও’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে জাতীয় পর্যায়ে সেরা জয়িতার পুরস্কার নিচ্ছেন রাজশাহীর কল্যানী মিনজি
ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সোনাদীঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কল্যানী মিনজি জাতীয় পর্যায়ে সেরা জয়িতা (শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্র) পুরস্কার নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে। আজ শুক্রবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অনুষ্ঠানে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার পাওয়ার পর প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় কল্যানী মিনজির। অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না। প্রধানমন্ত্রীকে এত কাছে পাব, স্বপ্নেও কোনো দিন কল্পনা করিনি। অনেকের সঙ্গে নিজেই ছবি তুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তাঁরাই আমার সঙ্গে ছবি তুলেছেন। আজকের অনুভূতিটা বলে বোঝানোর ক্ষমতা নেই আমার কাছে।’

প্রধানমন্ত্রী কিছু বলেছেন কি না এ ব্যাপারে কল্যানী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তুমি অনেক সাহসী, এগিয়ে যাও।’

সমাজের নানা প্রতিকূলতা আর বাধা অতিক্রম করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে পাঁচ নারীর হাতে জাতীয় পর্যায়ে ‘সেরা জয়িতা পুরস্কার-২০২৩’ তুলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কল্যানী ছাড়াও এই পুরস্কার পেয়েছেন আনার কলি (অর্থনৈতিক), কমলি রবি দাশ (সফল মা), জাহানারা বেগম (নিপীড়ন প্রতিরোধ) ও পাখি দত্ত হিজড়া (সামাজিক উন্নয়ন)।

আরও পড়ুন
কল্যানী মিনজি ওঁরাও, মুন্ডা, রাজোয়ার প্রভৃতি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য সাদরি ভাষার সরকারি পাঠ্যবই লিখে চলেছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় তাঁর বিদ্যালয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জাতীয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে উপজেলা পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে ৯ বছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

কল্যানী মিনজি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমার নিজের মতো কাজ করে গেছি। কখনো মনে হয়নি যে বেশি কিছু করছি। হয়তো তারা মনে করেছে যে আমি হয়তো দায়িত্বের বাইরে বেশি করেছি। আমি আমার কাজ করে যাব। সবারই সবার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে দেশ এগিয়ে যাবে। আমি কোনো দিন পুরস্কার পাওয়ার জন্য এটা করিনি।’

জয়িতা পুরস্কারপ্রাপ্তদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকার চেক, ক্রেস্ট, স্যাশ (উত্তরীয়) ও সনদ দেওয়া হয়। মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমা মোবারেক।

শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে সেরা জয়িতার পুরস্কার পেয়েছেন রাজশাহীর কল্যানী মিনজি। তাঁর সঙ্গে অতিথিরা ছবি তোলেন
ছবি: সংগৃহীত

জয়িতা পুরস্কারপ্রাপ্তদের পক্ষ থেকে কল্যানী মিনজি পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সামনে বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আজকের দিনটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিন। আমি নারী, আমিও পারি। আমি দুর্বল নই, একা নই। সরকারের এই উদ্যোগ ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত থাকুক এবং আমার মতো অনেক নারী স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে অবদান রাখুক।’

প্রধানমন্ত্রী কল্যানী মিনজির বক্তব্য শুনে বলেন, ‘আমি সত্যিই খুব আনন্দিত যে আমার এক বোন জয়িতা পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাবেন। নারীরাও যদি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে উদ্যোগী হন, তাহলে আমরা আরও দ্রুত অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।’

আরও পড়ুন

কল্যানী মিনজি দুর্বল শিক্ষার্থীদের আলাদা করে বাড়িতে পড়ান। শিক্ষার্থীদের শেখান কীভাবে সাইকেল চালাতে হয়, সাঁতার শেখানোও চলে একই সঙ্গে। ছোট ছোট শিশুদের ফুটবল তুলে দিয়েছেন। লিখে চলেছেন ওঁরাও, মুন্ডা, রাজোয়ার প্রভৃতি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য সাদরি ভাষার সরকারি পাঠ্যবই। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এর স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন রাজশাহী বিভাগীয় পর্যায়ে শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে জয়িতা পুরস্কার। আজ একই ক্যাটাগরিতে জাতীয় পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার পেলেন তিনি।

একাডেমিক লেখাপড়ার বাইরে শিক্ষার্থীদের সহপাঠক্রম শেখাচ্ছেন কল্যানী মিনজি
ছবি: সংগৃহীত

ওঁরাও সম্প্রদায়ের নারী কল্যানী মিনজি। তাঁরা ছয় বোন ও এক ভাই মিলে অনেক কষ্টে বড় হয়েছেন। ছয় বোনের মধ্যে কল্যানীসহ পাঁচ বোনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, আরেক বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ভাই কলেজে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বর্তমানে কল্যানী রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সোনাদীঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তিনি ১৯৬৯ সালের ২৭ অক্টোবর জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার উঁচাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কমলা মিনজি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। মা বাসন্তী রানী গৃহিণী। পরিবারে আর্থিক অনটন ও সামাজিক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ১৯৮৬-৮৭ শিক্ষাবর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন কল্যানী।

কল্যানী মিনজি বলেন, তাঁদের টানাটানির সংসার ছিল। বাবা স্কুল থেকে ফিরেই মাঠে নিয়ে যেতেন। নিজেরা জমি বর্গা নিতেন। সেই জমিতে কোনো শ্রমিক নিতেন না। নিজেরাই কাজ করতেন। স্কুলে যাওয়ার আগেও কাজ করতে হতো। খাওয়াদাওয়া ও অভাব-অনটনের পাশাপাশি লেখাপড়ার উপকরণ কিনতেও কষ্ট হতো। বাবা বিদ্যালয় থেকে পুরোনো পরীক্ষার খাতা এনে দিতেন। খাতার পেছনে এক–দুটি পৃষ্ঠা পাওয়া যেত লেখার জন্য। তা দিয়েই বাড়িতে লিখতেন। তবে বিদ্যালয়ে গিয়ে সব পড়া পারতেন। কল্যানী বলেন, ‘শিক্ষকেরা আমাদের উদাহরণ দিয়ে অন্য শিক্ষার্থীদের শাসন করতেন। আর বলতেন, ওরা এত কষ্ট করে পারে, তোমরা পারো না কেন?’

বিদ্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কল্যানী মিনজির প্রচেষ্টায় তাঁর বিদ্যালয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জাতীয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে উপজেলা পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে ৯ বছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ২০১২ ও ২০১৭ সালে দুবার উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৩ সালে উপজেলা পর্যায়ে তাঁর বিদ্যালয় শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় নির্বাচিত হয়। ওঁরাও সম্প্রদায়ের জন্য সাদরি ভাষায় শিশু, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য পাঠ্যবই লিখছেন। তাঁর বিদ্যালয়ে বাল্যবিবাহ নেই, ঝরে পড়া শিক্ষার্থী নেই। শুধু তা-ই নয়, ওঁরাও সম্প্রদায়ের জন্য সহজ ভাষায় শিশু, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির জন্য বই লিখেছেন। জয়িতার বাইরেও ২০১৮ সালে বেগম রোকেয়া দিবসে রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কৃতী নারী সম্মাননা পদক লাভ করেন।