ক্যানসারে আক্রান্ত মায়ের জন্য লড়াই জিন্নাতের

ক্যানসারে আক্রান্ত মায়ের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন জিন্নাত আরা। মায়ের সঙ্গে মেয়ে
ছবি: সংগৃহীত

পড়াশোনা, রাজনীতি, গান, ছবি আঁকা—এসব নিয়ে ভালোই কাটছিল দিন। হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো খবর এল—মায়ের স্তন ক্যানসার। সেই থেকে মাকে সুস্থ করার জন্য লেগে গেলেন জিন্নাত আরা। মায়ের ক্যানসার চিকিৎসার সেই লড়াই কয়েক বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। চিকিৎসা চালাতে গিয়ে স্নাতকের একটি বর্ষ বাদও দিয়েছেন।

জিন্নাত আরা রাজশাহী মহানগর ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি। বর্তমানে তিনি রাজশাহী কলেজে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তরে পড়ছেন। তাঁর ক্যানসারে আক্রান্ত মায়ের নাম সুফিয়া বেগম। ক্যানসারের সঙ্গে আছে তাঁর ডায়াবেটিসও। ছিল চোখের সমস্যাও। এক ভাই ও তিন বোন তাঁরা। ছোট বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগীতে স্নাতক শেষ করেছেন। বাবা জাবেদ আলী ব্যবসায়ী ছিলেন। করোনার পর থেকে তা–ও বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁরা রাজশাহী নগরের মীরেরচক এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন।

মায়ের চিকিৎসার জন্য জিন্নাতকে একাই ভারতে দুই দফা যেতে হয়। ২০২০ সালের মার্চে একবার যান। পরেরবার যান ২০২২ সালের ২৬ জুন। আবার যেতে হবে। ইতিমধ্যে চিকিৎসার জন্য প্রায় ২৬ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। জমিও বিক্রি করেছেন। এখনো চিকিৎসা বাবদ প্রতিদিন অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে।

জিন্নাত আরা বলেন, মায়ের ক্যানসারের খবরে পরিবারের সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। বাংলাদেশে চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচার করতে চাইলেন। বাবা-ভাইয়ের মতামত—দেশেই চিকিৎসা করাতে হবে। কিন্তু তিনি বেঁকে বসে ভারতে নিতে চাইলেন। মায়ের কষ্ট কমিয়ে সর্বোচ্চ ভালো চিকিৎসাটাই তাঁকে দিতে চাইলেন তিনি। এদিকে পরিবারেরও চিকিৎসা করানোর তেমন সামর্থ্যও ছিল না। স্নাতক চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রবেশপত্র টেবিলের ওপর রেখে একাই মায়ের চিকিৎসার সব দায়িত্ব নিয়ে দেড় মাসের মধ্যে কলকাতায় গেলেন। সম্বল মায়ের জমানো কিছু টাকা, আর ভাঙলেন একটা ফিক্সড ডিপোজিট। মা–মেয়ের সঙ্গে আর কেউ গেলেন না।

জিন্নাত বলেন, ‘রাজনৈতিক বোঝাপড়ার জায়গা থেকেই জানি যে অর্থনৈতিক কাঠামো এবং দেশীয় চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর অনাস্থা আমাদের আর্থিক সক্ষমতাকে এই বিপাকে ফেলেছে। তাই সব ধরনের লজ্জা, অস্বস্তি ভেঙে ছোট বোন ও তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা নেমে পড়ল বাক্স হাতে টাকা জোগাড় করতে। কিন্তু ওরা সময় পেল মাত্র সাত দিন। তারপরই করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এত অল্প সময়ের মধ্যে বড় একটা আর্থিক সহায়তা পাই আমরা। শুভাকাঙ্ক্ষীরা চাইলেন মা ফিরে আসুক।’

টাকা জোগাড় হতে না হতেই করোনার থাবা। তখন কলকাতায় তাঁরা। লকডাউন যেন একটা অচেনা শহরে মা-মেয়ের যুদ্ধকে আরও তীব্রতর করে তুলল। লকডাউনেই হলো সার্জারি। অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে দেশে ফেরায় আরেক পরীক্ষা দিতে হয় তাঁদের। সীমান্তে কড়াকড়ি। ভারতীয় ইমিগ্রেশন শেষ করে দেশে প্রবেশ করেই টানা ৪৫ দিনের ক্লান্তির সঙ্গে যুক্ত হলো অব্যবস্থাপনার পাহাড়। কারও কাছে কোনো সঠিক নির্দেশনা নেই। বেনাপোল সীমান্তে মুমূর্ষু রোগীদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয় বেনাপোলেই একটি কমিউনিটি সেন্টারে। সেখানেও লড়াই চালিয়ে পাঁচ দিনের মাথায় ফিরলেন রাজশাহীতে।

রাজশাহীতে এসে আরেক বাধা। এলাকাবাসী ভালোভাবে নিলেন না। রাজশাহীতে তখন লকডাউন চলছে। পুলিশ বাড়িতে এসে তুলে দিল। বাড়িতে ফিরে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিন সম্পন্ন করে রেডিও থেরাপির জন্য ঢাকায় স্থানান্তর হতে হলো দুই মাসের জন্য। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলল রেডিও থেরাপি। এ প্রক্রিয়াও এত সহজ ছিল না। করোনা আরও কঠিন করে দিল। ছোট বোন, শুভাকাঙ্ক্ষীদের সরব উপস্থিতি, সহযোগিতায় মানসিক চাপ কিছুটা কমে গেল। রেডিয়েশন শেষে বাড়িতে ফিরলেন তাঁরা। এর পর থেকে যুক্ত হলো কেমোথেরাপি। ছয় মাস অন্তর কেমোথেরাপি চলল তিন বছর ধরে। দামি ওষুধ, ডায়াবেটিসের ভয়াবহ জটিলতা মা–সহ পুরো পরিবারকেই পাড়ি দিতে হয়েছে।

জিন্নাত বলেন, মায়ের চিকিৎসার জন্য অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়া হলো না। লেখাপড়া, ক্যারিয়ার—সবকিছু বন্ধ রেখে মায়ের পাশেই থেকেছেন। তাঁর পাশে ছিল সংগঠন, বন্ধুরা, নাম না জানা আরও অনেকেই। গত সাড়ে তিন বছরে মায়ের চিকিৎসা, ওষুধ, দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদা—সবকিছু মিলিয়ে প্রায় ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আরও বাকি আছে চিকিৎসা। এর একটা বড় অংশ সম্ভব হয়েছে অনেক আন্তরিক মানুষের সহযোগিতায়। সামনে মায়ের চূড়ান্ত চেক-আপের জন্য আবার যেতে হবে ভারতে। এ জন্য অর্থের সংকট আছে। মায়ের যত দিন আয়ু আছে, তত দিন অন্তত ক্যানসারের যন্ত্রণার কিছুটা উপশমের ব্যবস্থা থাকলে তিনি তা–ই করবেন।

নগরের মীরেরচক এলাকার বাসায় গিয়ে কথা হয় জিন্নাতের মা সুফিয়া বেগমের সঙ্গে। মেয়ে জিন্নাত কীভাবে তাঁর সব চিকিৎসার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন, তা বলতে বলতে চোখ মুছতে থাকলেন। তিনি বলেন, ‘মেয়েটা অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা বাদ দিয়ে আমাকে নিয়ে গেল কলকাতায়। হাতে টাকা ছিল না। করোনার সবকিছু বন্ধ। লজ্জা-শরম ভেঙে বিভিন্ন মানুষের কাছে টাকা চেয়েছে। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে জিন্নাত তার নিজের কথা ভাবেনি। এখনো চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। মানুষ অনেক দিয়েছে। আবার দিলে জিন্নাতের কষ্ট কমবে।’